‘আর্ রাহমান’ (অযাচিত অসীম দাতা) এবং ‘আর্ রাহীম’ (পরম দয়াময়) এই উভয় শব্দ একই ‘রাহেমা’ ধাতু হইতে উৎপন্ন। ‘রাহেমা’ অর্থ সে দয়া প্রদর্শন করিল, সে ক্ষমা করিল। ‘রহমত’ শব্দের মধ্যে দুইটি ভাব আছেঃ একটি ভাব হইল ‘রিক্কাত’ দয়ার্দ্রতা ও কোমলতার ভাব, আর অপরটি হইল ‘ইহ্সান’ বা পরোপকারের ভাব (মুফরাদাত)। ‘আর্ রাহমান’ শব্দটি ‘ফা’লান ওজনে এবং ‘আর্ রাহীম’ শব্দটি ‘ফায়ীল’ ওজনে আসিয়াছে। আরবী ভাষার নিয়ম ইহাই যে, মূল শব্দের সহিত যতবেশী অক্ষর যুক্ত হইবে, ততই ইহার অর্থের ব্যাপকতা বা গভীরতা বৃদ্ধি পাইবে (কাশ্শাফ)। ‘ফা’লান ওজনের শব্দে পূর্ণতা ও ব্যাপকতা থাকে এবং ‘ফায়ীল’ ওজনের শব্দে ক্রিয়ার পৌনঃপুণিকতা ও বদান্যতা প্রকাশ পায় (মুহিত)। অতএব, এই হিসাবে, ‘আর্-রাহমান’ দ্বারা সারাবিশ্ব পরিবেষ্টনকারী দয়া বুঝায়, এবং ‘আর্ রাহীম’ দ্বারা সেই দয়াকে বুঝায় যা সীমিত হইলেও বার বার প্রদর্শন বুঝায়। উপরোক্ত অর্থের আলোকে আর রহমান ঐ সত্তাকে বুঝায় যিনি অযাচিত ভাবে ও ব্যাপকভাবে, কাহারও সাধনা বা কর্মের সহিত সম্পর্ক-শূন্য রূপে সকল সৃষ্টির প্রতিই সমভাবে কৃপা বর্ষণ করিয়া থাকেন এবং আর্ রাহীম দ্বারা ঐ সত্তাকে বুঝায় যিনি মানুষের কাজের বিনিময়ে, সৎকাজের পুরস্কারস্বরূপ দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাইয়া থাকেন এবং ইহা বদান্যতার সহিত বার বার দেখান। ‘আর্ রাহমান’ শব্দটি কেবল মাত্র আল্লাহ্র জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু ‘রাহীম’ শব্দটি দয়ালু মানুষের জন্যও ব্যবহাত হইতে পারে। পূর্ববর্তী শব্দটি অবিশ্বাসী বিশ্বাসী নির্বিশেষে সর্ব মানবকেই শুধু নহে, বরং সারা বিশ্বের সব সৃষ্টিকেই স্বীয় আওতার মধ্যে ধারণ করে। কিন্তু পরবর্তী (অর্থাৎ ‘রাহীম’) শব্দটি প্রধানতঃ বিশ্বাসীগণকে আওতাভুক্ত করে। মহানবী (সাঃ)-এর একটি বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ্তা’লার ‘আর্ রাহমান’ এর গুণটির প্রকাশ সাধারণভাবে ইহকালের (নেয়ামত সমূহের) সহিত সম্পৃক্ত, এবং ‘আর্ রাহীম’-এর গুণটির প্রকাশ পরকালের (নেয়ামত সমূহের) সহিত সম্পৃক্ত (মুহিত)। ইহা দ্বারা বুঝা যায়, যেহেতু এই বিশ্ব (ইহকাল) মানুষের জন্য এক বিরাট কর্মক্ষেত্র এবং পরকাল তাহার কর্মের সবিশেষ ফল প্রাপ্তির স্থান, সেই হেতু ‘আর্ রাহমান’ মানুষের কর্তব্য সম্পাদনের উপযোগী সব বস্তু ইহজগতে সরবরাহ করেন এবং ‘আর্ রাহীম’ রূপে পরকালে ফলপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করিয়া থাকেন। যাহা কিছু আমাদের প্রয়োজন এবং যাহা কিছু আমাদের জীবন ধারণের জন্য আবশ্যক, উহার সব কিছুই বিনা পরিশ্রমে, বিনা যোগ্যতায় ও বিনা চাওয়ায় আমাদের জন্মের পূর্ব হইতেই, শুধু ঐশী অনুগ্রহস্বরূপ, আমাদের জন্য মওজুদ থাকে। তবে, পরকালে যে সকল ঐশী আশীর্বাদ মওজুদ রহিয়াছে, তাহা ইহকালীন কাজের পুরস্কার স্বরূপ আমাদিগকে আপন আপন যোগ্যতানুসারে দেওয়া হইবে।
ইহা দ্বারা এই কথাই বুঝা যায় যে, ‘আর্ রাহমান’ হইলেন সেই মহান দাতা যিনি আমাদের জন্মের পূর্বেই আমাদের জন্য সব কিছুই দিয়া রাখিয়াছেন, ‘আর্-রাহীম’ হইলেন সেই কল্যাণবর্ষণকারী যিনি কাজের বিনিময়ে পুরস্কার দান করেন।
‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ কুরআনের প্রতিটি সূরার (অধ্যায়ের) প্রথম আয়াত, অবশ্য সূরা তওবা বা বরাআত ছাড়া। তবে, সূরা ‘বরাআত’ সূরা ‘আনফালের’ বর্দ্ধিত অংশবিশেষ, স্বাধীন ও পৃথক সূরা নহে। ইবনে আব্বাস হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, যখনই কোন নূতন সূরা নাযেল হইত, তখনই বিসমিল্লাহ্ আয়াতটি প্রথমে আসিত। বিস্মিল্লাহ্ না আসা পর্যন্ত রসূলুল্লাহ (সাঃ) জানিতে পারিতেন না যে, নূতন সূরা আরম্ভ হইয়াছে (দাউদ)। ইহাতে বুঝা যায় (১) বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম আয়াতটি কুরআনেরই অংশ, অতিরিক্ত কোন কিছু নহে, (২)সূরা ‘বরাআত’ স্বাধীন সূরা নহে। হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনা সেই সকল লোকের ধারণাকে খণ্ডন করে, যাহারা বলেন, ‘বিসমিল্লাহ’ কেবল মাত্র সূরা ফাতেহার অংশ, অন্যান্য সূরার অংশ নহে। হযরত রসূল করীম (সাঃ) ইহাও বলিয়াছেন যে, ‘বিস্মিল্লাহ্’ কুরআনের প্রতিটি সূরারই অংশ (বুখারী এবং কুৎনী)। প্রতিটি সূরার প্রারম্ভে ‘বিস্মিল্লাহ্’ ব্যবহারের তাৎপর্য হইতেছেঃ কুরআন ঐশী জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার, আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া সেই জ্ঞানের ধারে কাছে পৌঁছানো কাহারও পক্ষে সম্ভব নয়। ‘পবিত্রগণ ছাড়া কেহ ইহাকে স্পর্শ করিবে না’ (৫৬ঃ৮০)। সেই কারণেই, প্রতিটি সূরার প্রারম্ভে ‘বিস্মিল্লাহ্’ সংযুক্ত করিয়া মুসলমানদিগকে স্মরণ করানো হইয়াছে যে, কুরআনে বিধৃত ঐশী জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশলাভ করিতে হইলে এবং ইহা হইতে প্রকৃত উপরকার লাভ করিতে হইলে, তাহাদিগকে কেবল পবিত্র হৃদয় লইয়া অগ্রসর হইলেই চলিবে না, বরং পদে পদে অতিশয় মিনতির সহিত আল্লাহ্তা’লার সাহায্যও চাহিতে হইবে। ‘বিসমিল্লাহ’ আয়াতটি আরও একটি প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে—ইহাতে প্রত্যেক সূরার অর্থের ও তাৎপর্যের চাবিকাঠি রহিয়াছে। কেননা, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি, কোনও না কোনও ভাবে, প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে আল্লাহ্তা’লার মৌলিক গুণ ‘রাহমানীয়ত’ (অযাচিত-অসীম দান) বা ‘রাহীমিয়ত’ (বার বার দয়া প্রদর্শন)-এর সাথে সম্পর্কিত। এইরূপে, প্রত্যেক সূরাই বস্তুতঃ ‘বিস্মিল্লাহ্’ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ্তা’লার মূল-গুণাবলীর সবিস্তার ব্যাখ্যা ও বিবরণ মাত্র। অনেক সময় তর্ক উত্থাপন করা হয় যে, ‘বিসমিল্লাহ্’ কথাটি সূত্র হিসাবে পূর্ববতী ধর্মগ্রন্থ হইতে ধার করা হইয়াছে। সেল বলেন, ইহা যেন্দাবেস্তা হইতে অনুকরণ করা হইয়াছে। আর প্রাচ্যবিদ রড্ওয়েল বলেন, ইসলাম-পূর্ব আরবগণ ইহা ইহুদীদের নিকট হইতে ধার করিয়াছিল এবং পরে তাহা কুরআনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। এই দুইটি অভিমতই স্পষ্টতঃ ভুল। প্রথম কথা হইল, মুসলমানেরা কখনও দাবী করেন নাই যে, এই সূত্রটি, এই আকারে বা অন্য আকারে, কুরআন অবতরণের পূর্বে মানুষের অজানা ছিল। দ্বিতীয়তঃ এইরূপ তর্ক উঠানোও ঠিক নয় যে, যেহেতু এই সূত্রটি কোনও না কোন আকারে ইসলাম-পূর্ব আরবেরা, কুরআন অবতরণের আগেই কিছুদিন ব্যবহার করিয়াছে, অতএব, ইহা ঐশী-বাণী হইতে পারে না। বস্তুতঃ, কুরআনেই উল্লেখ আছে যে, সুলায়মান (আঃ) সাবার রাণীর কাছে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা এই ‘বিসমিল্লাহ্’ দিয়াই আরম্ভ করিয়াছিলেন (২৭ঃ৩১)। মুসলমানেরা যাহা দাবী করেন এবং যে দাবীকে কেহই অস্বীকার করিতে পারে নাই, তাহা এই যে, কুরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যাহা ‘বিসমিল্লাহ্’ সূত্রটিকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করিয়াছে, পূর্ববর্তী কোনও ধর্মগ্রন্থ এইরূপ যথোপযুক্ত ভাবে ইহার ব্যবহার করে নাই। এই কথা বলাও মারাত্মক ভুল যে, ইসলাম-পূর্ব আরবগণ এই সূত্রটির ব্যবহার অহরহ করিত, কেননা ইহা সকলেরই জানা কথা যে, তাহারা আল্লাহ্কে ‘আর্ রাহমান’ নামে আখ্যায়িত করাকে ঘৃণার কাজ মনে করিত। যাহা হউক, যদি এইরূপ সূত্র পূর্বেও প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে করা হয়, তাহাতে কুরআনেরই সত্যতা সাব্যস্ত হয়, যেহেতু কুরআনই বলে, এমন জাতি নাই, যাহাদের মধ্যে ঐশী-শিক্ষাদাতা পাঠানো হয় নাই (৩৫ঃ২৫); আরও বলে, পূর্বেকার অবতীর্ণ গ্রন্থাবলীর সকল চিরস্থায়ী সত্য ও স্থায়ী শিক্ষামালা কুরআনে সঞ্চিত করা হইয়াছে (৯৮ঃ৪)। অবশ্যই কুরআনে আরও বহু কিছু নূতন ভাবে সংযোজিত হইয়াছে। তবে যাহা কিছু অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে, কুরআন সেইগুলিকে উন্নতরূপ দিয়াছে ও অধিকতর উন্নত পর্যায়ে অভিষিক্ত করিয়া উন্নতভাবে ব্যবহারোপযোগী করিয়াছে।