‘আল্-আলামীন’, ‘আলাম’ শব্দের বহুবচন। ‘আলাম’ শব্দ, ‘ইলম্’ ধাতু হইতে উৎপন্ন, আর ‘ইলম’ অর্থ ‘জানা’। ‘আলাম’ শব্দটা ঐ সকল জীব-জন্তু গাছপালা ও বস্তুনিচয়কে বুঝায়, যাহাদের সাহায্যে কেহ সৃষ্টিকর্তাকে জানিতে পারে (আকরাব)। ইহা কেবল সৃষ্ট জীব-জন্তু বা সৃষ্ট বস্তুনিচয়ের সমষ্টিকে বুঝায় না বরং ইহাদের বিভিন্ন শ্রেণী-বিন্যাসকেও বুঝাইতে পারে। যেমন ‘আলামুল্-ইনস’ বলিতে বুঝায় মানব জগত, ‘আলামুল-হায়ওয়ান’ বলিতে বুঝায় পশু-জগৎ, ইত্যাদি। ‘আল্-আলামীন’ বলিতে বুদ্ধিসম্পন্ন মানব ও ফিরিশ্তাকেই কেবল বুঝায় না, বরং সমস্ত সৃষ্ট বস্তুকেই বুঝায় (২৬ঃ২৪-২৯ ও ৪১ঃ১০)। সময় সময়, ইহা সীমিত অর্থেও ব্যবহৃত হয় (২ঃ১২৩)। এ স্থলে ইহা সর্বাপেক্ষা ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সব কিছুকেই বুঝাইয়াছে, অর্থাৎ বিশ্ব-চরাচরের সবকিছুসহ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র যাহা কিছু বিশ্ব সৃষ্টিতে আছে, তাহারা সবই ‘আলামীন’-এর অন্তর্ভুক্ত।
‘সকল প্রশংসাই একমাত্র আল্লাহ্র’ এই বাক্যটি, ‘আমি আল্লাহ্র প্রশংসা করি’ বাক্য হইতে অনেকগুণ বেশী ব্যাপক ও গভীর। কারণ, মানুষ তাহার সীমিত জ্ঞানানুযায়ী আল্লাহ্কে প্রশংসা করিতে পারে। কিন্তু ‘সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহ্র’ বলাতে, এই বাক্যের মধ্যে, মানুষের জ্ঞাত প্রশংসা ত থাকেই, তাহার অজ্ঞাত অজানা প্রশংসাও অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়। আল্লাহ্ সব সময় ও সর্বাবস্থায় প্রশংসার যোগ্য, মানুষের অপূর্ণ জ্ঞান বা চেতনায় তাহা বুঝা যাউক বা না যাউক, মানুষের উপলব্ধিতে তাহা ধরা পড়ুক বা না পড়ুক। সর্বোপরি ব্যাকরণগতভাবে, হাম্দ শব্দটি অসমাপিকা ক্রিয়া বিশেষ। অতএব, আল্লাহ্ সেই ক্রিয়ার কর্তা বা কর্ম উভয়ই হইতে পারেন। কর্তা হইলে, অর্থ হইবে আল্লাহ্ই সত্যিকার প্রশংসা করিবার একমাত্র অধিকারী। আর কর্মকারক হইলে, অর্থ দাঁড়াইবে, সকল প্রকারের সত্য ও পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্তা’লারই প্রাপ্য। ‘আল্’ অর্থ ৫ টীকায় দেখুন।
এই আয়াতে বিশ্বের ক্রমোন্নয়ন বা বিবর্তন ধারার কথা বলা হইয়াছে অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুই ক্রমোন্নয়নের ধারায় পর্যায়ক্রমে স্তর হইতে স্তরান্তরে উন্নতি লাভ করে, রাব্ব্ হইলেন তিনিই যিনি সৃষ্টি করেন, বর্দ্ধিত করেন ও পর্যায়ক্রমে উন্নতি দান করেন। ইহাতে এই কথাও বুঝা যায় যে, বিবর্তন ও ক্রমোন্নয়ন আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। কিন্তু এখানে যে বিবর্তনের কথা বলা হইয়াছে তাহা, সাধারণভাবে প্রচলিত বিবর্তনবাদ (যাহাকে ইংরেজীতে বলা হয় থিওরী অব ইভলিউশন) নহে। এই আয়াত হইতে বুঝা যায়, সীমাহীন উন্নতির জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হইয়াছে, কারণ ‘রাব্বুল আলামীন’ শব্দগুলিতে এই কথা নিহিত রহিয়াছে যে, আল্লাহ্তা’লা প্রত্যেক বস্তুকে নিম্ন পর্যায় হইতে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন। আর এইরূপ করা তখনই সম্ভব যখন এক উন্নত স্তরের পরে আরো উন্নত স্তর থাকে এবং এইভাবে অশেষ স্তর থাকে।