এই সূরাটিতে আল্লাহ্র তিনটি বিশেষ গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হইয়াছে যথা, ‘রাব্ব্’ (মানুষের প্রতিপালক), ‘মালিক’ (মানুষের বাদশাহ) এবং ‘ইলাহ্’ (মানুষের উপাস্য)। আর এই তিনটি নামেই আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করিতে বলা হইয়াছে।পূর্ববতী সূরা ফালাকে কেবল ‘রাব্বুল ফালাকের’ (প্রভাতের প্রতিপালকের) নিকটেই সাহায্য চাওয়ার আদেশ দেওয়া হইয়াছে। ইহার কারণ এই যে, ‘রাব্বুল ফালাক’ এর মধ্যে ঐতিনটি গুণবাচক নামের বৈশিষ্ট্যগুলিও রহিয়াছে। লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ববতী সূরাতে, চারিটি দুস্কৃতি ও অনিষ্টের বিরুদ্ধে আল্লাহ্র একটি মাত্র নামের দোহাই দিয়া সাহায্য চাওয়া হইয়াছে, অথচ বর্তমান আলোচ্য সূরাতে একটি মাত্র ‘নষ্টামী’ তথা শয়তানী কুমন্ত্রণা ও গোপন ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনটি নামের দোহাই দিতে বলা হইয়াছে। ইহার কারণ এই যে, শয়তানের প্ররোচনা বা কুমন্ত্রণাই সর্বপ্রকারের অনিষ্টের মূল হইয়া থাকে। আল্লাহ্র (রাব্ব্, মালিক, ইলাহ) এই তিনটি গুণের সহিত মানুষের দৈহিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার সূক্ষ্ম সম্পর্ক রহিয়াছে। ‘রাব্ব্’ নামক গুণের আওতায় মানুষের শারীরিক ও নৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। তাহার চিন্তা, কথাবার্তা ও কাজ কর্ম ‘মালিক’ নামের আওতায় পুরস্কৃত বা সাজা প্রাপ্ত হয়। তাঁহার ‘ইলাহ’ নামটি ইহাই ব্যক্ত করে যে, তিনিই ভালবাসা, ভক্তিশ্রদ্ধা ও উপাসনার পাত্র এবং তাঁহাকে পাওয়াই মানবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই তিনটি নামের উল্লেখ এই কথার ইঙ্গিত প্রদান করে যে, তিনটি কারণে সকল পাপের উৎপত্তি হয় যথাঃ যখন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ‘প্রতিপালক’ মনে করে কিংবা সর্বময় অধিকারী মালিক মনে করে, অথবা স্বীয় উপাসনার যোগ্য ইলাহ মনে করে। অর্থাৎ যখন সে অপর ব্যক্তিকে তাহার জীবনের একমাত্র অবলম্বন মনে করে, তাহার অবৈধ কর্তৃত্বের নিগড়ে নিজেকে দাসের মত বাঁধিয়া রাখে এবং তাহাকে নিজের ভালবাসা ও পূজার একমাত্র পাত্র মনে করে। মো’মেনদেরকে এখানে সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ করা হইয়াছে, তাহারা যেন একমাত্র আল্লাহ্কেই তাহাদের জীবনের অবলম্বন মনে করে, অসঙ্কোচে তাঁহারই আনুগত্যের মধ্যে থাকিয়া জীবন যাপন করে এবং তাঁহাকেই ভক্তি-ভালবাসা, শ্রদ্ধা-প্রেম ও উপাসনার একমাত্র পাত্র মনে করে। অথবা আল্লাহ্তা’লার এই তিনটি বিশেষ নামের দোহাই দেওয়ার মাঝে এই তাৎপর্যও থাকিতে পারেঃ শোষক পুঁজিবাদীদের কারসাজিপূর্ণ প্রতিপালনকারীর মত চটকদার ভূমিকা দেখিয়া মো’মেনগণ যেন প্রকৃত প্রতিপালক ‘রাব্বুন্নাস’কে ভুলিয়া না যায়, বড় বড় বিশ্ব-শক্তিগুলির মন-ভুলানো রাজনৈতিক মতবাদ ও ক্ষমতার অত্যাশ্চর্য ভেল্কিবাজি দেখিয়া, তাহাদিগকেই না আসল মালিকের আসনে বসাইয়া দেয় এবং সুচতুর বক-ধার্মিকদের চালাকিপূর্ণ বাহ্যিক আধ্যাত্মিকতার মোহে মানবসৃষ্ট ‘ইলাহ’ বা উপাস্যগণের মোকাবিলায় যেন সত্য ‘ইলাহিন্নাস’কে অবহেলা না করে। সাধারণ মানবের জন্য এইরূপ ভুল করার সম্ভাবনা রহিয়াছে। তাই আল্লাহ্তা’লা কুরআনের শেষ পর্বে মানুষের আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে তাঁহারই সাহায্য প্রার্থনার দোয়া আবার শিখাইয়াছেন যাহাতে মো’মেন বান্দা ঐরূপ ভুল করা হইতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে।