৩০৩৭

নবী করীম (সাঃ)-এর আগমন সম্বন্ধে হযরত ঈসা (আঃ) যে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, তাহা বাইবেলের, যোহন ১২ঃ১৩, ১৪ঃ১৬-১৭, ১৫ঃ২৬ ও ১৬ঃ৭ লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। ভবিষ্যদ্বাণীতে মহানবী (সাঃ)-কে ‘প্যারাক্লিত’ বা ‘কমফর্টার’ বা ‘স্পিরিট অব ট্রুথ’ নামে অভিহিত দেখিতে পাওয়া যায়। এই নামটি ও আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করিলে ভবিষ্যদ্বাণীর মর্ম পরিষ্কার বুঝা যাইবেঃ (ক) ভবিষ্যদ্বাণীতে আছে যে, ঈসা (আঃ)-এর ইহলীলা ত্যাগের পর শান্তিদাতা (প্যারাক্লিট বা কমফর্টার ) বা সত্যের আত্মা (স্পিরিট অব ট্রুথ) আগমন করিবেন, (খ) তিনি (আগমনকারী) পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী হইবেন। তিনি আসিয়া বহু বিষয়ে অনেক অনেক কথা বলিবেন, যাহা ঈসা (আঃ) স্বয়ং তখন বলিতে পারেন নাই, কেননা মানুষ ঐগুলির গুরুত্ব ও দায়িত্ব বহন করিবার উপযুক্ত শক্তি তখনও প্রাপ্ত হয় নাই, (গ) তিনি মানুষকে সাকল্য সত্যে পরিচালিত করিবেন, (ঘ) তিনি নিজ হইতে কিছুই বলিবেন না বরং যাহা যাহা তিনি শ্রবণ করিবেন, তাহা তাহাই তিনি বলিবেন, (ঙ) তিনি আসিয়া ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা উচ্চ করিবেন এবং তাঁহার সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন। (শান্তিদাতা সত্যের আত্মা)-এর বর্ণনা, কুরআনে প্রদত্ত মহানবী (সাঃ)-এর গুণাবলী, মর্যাদা, আদর্শ ও লক্ষ্য সম্বন্ধীয় বর্ণনার সাথে হুবহু মিলিয়া যায়। ঈসা (আঃ)-এর ইহজগৎ ত্যাগের পরে মহানবী (সাঃ)-এর আবির্ভাব ঘটে, তিনি চিরস্থায়ী শরীয়াতসহ আগমন করেন, কুরআন বিশ্বমানবের জন্য সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ যাহা কেয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকিবে (৫ঃ৪)। তিনি নিজ হইতে কিছু বলেন নাই, বরং আল্লাহ্‌র কাছ হইতে যাহা শুনিয়াছেন, তাহাই তিনি বলিয়াছেন (৫৩ঃ৪)। তিনি ঈসা (আঃ)-এর গুণ-কীর্তন করিয়াছেন (২ঃ২৫৪, ৩ঃ৫৬)। যোহনের সুসমাচারে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিটি কথা, কুরআনের এই আয়াতে প্রদত্ত ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী-যুক্ত কথাগুলির সাথে মিলিয়া যায়, কেবল প্যারাক্লিত নামটির স্থলে ‘আহমদ’ নাম ব্যবহৃত হইয়াছে। বাইবেলের ও কুরআনের বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা সত্বেও কেবল নামের বিভিন্নতার উপর ভিত্তি করিয়া, খৃষ্টান লেখকগণ কুরআনের বর্ণিত এই ভবিষ্যদ্বাণীকে, ঈসা (আঃ)-এর প্যারাক্লিত সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী বলিয়া মানিয়া নিতে অস্বীকার করেন ও চ্যালেঞ্জ করেন। আসল কথা হইল, ঈসা (আঃ) ‘আরামাইক’ ও হিব্র-এই দুই ভাষায়ই কথা বলিতেন। আরামাইক ছিল তাঁহার মাতৃ-ভাষা আর হিব্রু ছিল তাহার ধর্মীয় ভাষা। বাইবেলের যে পঠন আমরা পাই, তাহা আরামাইক ও হিব্রু ভাষার বাইবেলের গ্রীক অনুবাদ। আরামাইক বা হিব্রু বাইবেলের অস্তিত্ব এখন নাই। তাই গ্রীক ভাষায় অনূদিত বাইবেল হইতে অন্যান্য ভাষায় বাইবেল অনূদিত হইয়া আসিয়াছে। স্বভাবতঃই অনুবাদ ‘আসলের’ পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করিতে পারে না, কেননা প্রত্যেক ভাষারই সীমাবদ্ধতা রহিয়াছে। তাহা ছাড়া, প্রত্যেক ভাষা-ভাষী জাতিরও প্রকাশের সীমাবদ্ধতা থাকে। তাহাদের সেই সীমাবদ্ধতা তাহাদের লিখার মধ্যেও প্রকাশ পায়। গ্রীক ভাষায় ‘প্যারিকুটাস’ একটি শব্দ রহিয়াছে, যাহার অর্থ আরবী ভাষার ‘আহমদ’ শব্দের অর্থের অনুরূপ। খৃষ্ট-ধর্ম বিশারদ জেক ফিনেগান তাহার ‘দি আরকিওলজী অব রিলিজিওন’ পুস্তকে লিখিয়াছেন, “গ্রীকভাষায় ‘প্যারাক্লিটাস’ (শান্তি-দাতা) আর ‘প্যারিক্লুটাস’ একই ধরণের শব্দ দ্বিতীয় শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘আহমদ’ এবং মুহাম্মদ”। প্রাচীন কায়রো শহরের এয্‌রা সিনাগগে উণবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে “দামাস্কাস ডকুমেন্ট” নামের একটি ধর্ম পুস্তকের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় দেখা যায়, ঈসা (আঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছেন যে ‘এমেদ’ নামে একজন পবিত্র আত্মার আগমন হইবেঃ “তিনি (সদাপ্রভু) তাঁহার মসীহের দ্বারা, তাহাদিগের কাছে তাঁহার (প্রেরিত) পবিত্র আত্মার পরিচয় ঘটাইলেন। কেননা তিনিই ‘এমেদ’ (অর্থ সত্যবাদী,আল আমীন)। এবং তাঁহার (সদাপ্রভুর) নামানুসারে … ‘এমেদ’ হিব্রু শব্দ, যাহার অর্থ হইল ‘সত্য’ অথবা ‘সত্যবাদী মহান ব্যক্তি যিনি নিরন্তর ভাল’ (ট্রাচানস ফোর্থ গসপেল, পৃঃ ১৪১)। ইহুদীরা এই শব্দটিকে ব্যাখ্যা করিয়াছে ‘আল্লাহ্‌র মোহর’ বলিয়া।যদিও ঈসা (আঃ) স্বয়ং ‘আহমদ’ শব্দটিই ব্যবহার করিয়াছিলেন তথাপি ‘আহমদ’ ও ‘এমেদ’ এই দুই শব্দের অর্থে ও উচ্চারণে সামঞ্জস্য থাকার কারণে পরবর্তী হিব্রু ভাষাভাষী লিখকগণ ‘আহমদ’ শব্দের স্থলে ‘এমেদ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। অতএব এই আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীতে ব্যবহৃত ‘আহমদ’ শব্দটি মহানবী (সাঃ)-এর উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হইয়াছে। এই যুক্তিধারার অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে আহমদীয়া জামাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রতিশ্রুত মসীহের উপরও এই ভবিষ্যদ্বাণী সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা তাঁহাকেও আল্লাহ্‌তা’লা ওহীর মাধ্যমে ‘আহমদ’ নামে অভিহিত করিয়াছেন (বারাহীনে আহমদীয়া) এবং তাঁহার আগমনের মাধ্যমে মহানবী (সাঃ)-এর দ্বিতীয় প্রকাশ বা দ্বিতীয় আগমনের বাস্তবায়ন ঘটিয়াছে। মহানবী (সাঃ)-এর দ্বিতীয় প্রকাশ বা অভূদয়ের কথা সূরা জুমু’আর তৃতীয় আয়াতে সূক্ষ্ম ও স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ‘বার্নাবাসের সুসমাচারে’ মহানবী (সাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হইয়াছে। খৃস্টান গীর্জা সাধারণভাবে বার্নাবাসের সুসমাচারকে সঠিক ও সন্দেহমুক্ত মনে করে না। তাহা সত্ত্বেও, এই সুসমাচারটিও অন্য চারটি সুসমাচারের মতই সমপর্যায়ের গুরুত্ব রাখে।