২৮৯৬

খালি চোখে দেখা চন্দ্রের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনাটা প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতিকূলে বা লংঘনে সম্পন্ন হইয়াছিল কিনা তাহা বলা মুস্কিল। কিন্তু অকাট্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণে সন্দেহাতীতভাবে সত্য সাব্যস্ত ঘটনাকে অস্বীকার করা আরও বেশী মুস্কিল। ঐশী গুপ্ত-তত্ত্ব ও প্রকৃতির রহস্যাবলীর অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণ উন্মোচিত হইয়াছে বা পূর্ণমাত্রায় বোধগম্য হইয়াছে কিংবা ইহাদের সকল কিছু উদঘাটিত হইয়াছে, এইরূপ দাবী কেহই করিতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে এইরূপ কথাও কল্পনা করা যায় না যে, বিশ্বের এক বিরাট এলাকা জুড়িয়া এমন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল, আর পৃথিবীর কোন মানমন্দিরে তাহা ধরা পড়িল না বা রেকর্ডভুক্ত হইল না কিংবা ইতিহাসের পাতায় তাহা লিপিবদ্ধ হইল না। কিন্তু দেখা যায় যে, বিশ্বস্ত হাদীসের গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফেও এই ঘটনার বর্ণনা রহিয়াছে। বিশিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য হাদীস-বেত্তাগণ একের পর এক ক্রমাগতভাবে তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। ইহাতে বুঝা যায় যে, এইরূপ অস্বাভাবিক ধরণের একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য মহানবী (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় নিশ্চয়ই দেখা গিয়াছিল। কুরআনের তফসীরকারকদের মধ্যে অনেকেই (যথাঃ ইমাম রাযী) এই ঘটনার জটিলতা দেখিয়া বলিয়াছেন যে, এই ঘটনাটি একটি চন্দ্র-গ্রহণ ছিল। ইমাম গাযযালী ও শাহ ওলীউল্লাহ এই মতের সমর্থনে বলেন যে, চন্দ্র আসলে দ্বিখণ্ডিত হয় নাই। তবে আল্লাহ্‌ এমনই কৌশল প্রয়োগ করিয়াছিলেন যে, মানুষের চোখে চন্দ্রটি দ্বিখণ্ডিত বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল। হযরত ইবনে আব্বাস ও শাহ আব্দুল আযীযের মতেও ইহা এক বিশেষ ধরণের চন্দ্র-গ্রহণ ছিল। যাহা হউক, যে উদাত্ত ভাষায় এই ঘটনাটি কুরআনে উল্লেখ করা হইয়াছে তাহাতে বিন্দু-বিসর্গ সন্দেহ থাকে না যে, ব্যাপারটি চন্দ্রগ্রহণের চাইতে অনেক বড় কিছু ছিল। অবিশ্বাসীরা মহানবী (সাঃ)-কে বারবার অলৌকিকত্ব প্রদর্শনের জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছিল। তাই, মহানবী (সাঃ) মু’জেযা স্বরূপ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় এই ঘটনার অবতারণা করিয়াছিলেন (বুখারী ও মুসলিম)। মনে হয়, ইহা মহানবী (সাঃ)-এর একটি উচ্চ পর্যায়ের দিব্য-দর্শন বা কাশফ ছিল, যাহাতে কয়েকজন সাহাবী ও কয়েকজন কাফেরকে অংশ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল, যেমনটা ঘটিয়াছিল মূসা (আঃ)-এর বেলায়, মূসা (আঃ)-এর লাঠি চলন্ত সাপের মত হইয়া যাওয়ার ব্যাপারটাও ছিল এক উচ্চাঙ্গের দিব্য-দর্শন, যাহাতে ফেরাউনের যাদুকরগণ অংশীদারিত্ব পাওয়ায় তাহারাও লাঠিকেই চলন্ত সর্পরূপে দেখিয়াছিল। নবীগণের আত্মিক প্রভাবেই এইরূপ অস্থায়ী অংশীদারিত্ব সৃষ্ট হয়। মূসা (আঃ) যখন নিজের লাঠি দ্বারা সমুদ্র-জলে আঘাত করিলেন তখন ছিল ঠিক ভাটার সময় এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ব্যাপারটা একটা মু’জেযাতে পরিণত হইল। ঠিক এমনিভাবে হয় তো বা নবী করীম (সাঃ)-কে আল্লাহ্‌তা’লা এমনি একটি মুহূর্তে ‘চন্দ্র-দ্বিখণ্ডিত’ করিয়া দেখাইবার আদেশ দিলেন, যখন চন্দ্রের ব্যাসের উপর দূরবর্তী মহাকাশের কোন গ্রহ বা তারকার স্বল্পস্থায়ী ছায়া পড়ার সময় ছিল, যাহার কারণে চন্দ্র দ্বিধাবিভক্ত দেখাইয়াছিল কিন্ত সর্বাপেক্ষা উওম ও আধ্যাত্নিক অর্থ পূর্ণ ব্যাখ্যা হইল এই যে, চন্দ্র ছিল আরবদের জাতীয় প্রতীক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার নিদর্শন, যেমন সূর্য হইল পারস্য জাতি-সত্তার চিহ্ন। খয়বরের ইহুদী নেতা ইব্‌নে আখ্‌তারের কন্যা সফিয়া যখন তাহার পিতার কাছে আপন স্বপ্ন বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিলেন যে, তিনি তাহার কোলে চন্দ্র পতিত হইতে দেখিয়াছেন, তখন পিতা কন্যাকে সজোরে চপেটাঘাতে করিয়া বলিল, “তুই সারা আরবের অধিপতিকে বিবাহ করিতে চাস?” খয়বর বিজয়ের পর মহানবী (সাঃ)-এর সাথে সফিয়ার বিবাহ হওয়ার মাধ্যমে এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হইয়াছিল (যুরকানী ও উস্‌দুল গাব্বা)। এইরূপ, হযরত আয়েশা (রাঃ) স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন যে, তাঁহার বাসগৃহে তিনটি চাঁদ পতিত হইয়াছে। মহানবী (সাঃ), হযরত আবুবকর ও হযরত উমরের (রাঃ) এই বাসগৃহে একের পর এক, দাফনের মধ্যেমে এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয় (মুয়াত্তা, কিতাবুল জানায়েয)। কমর (চন্দ্র) শব্দের এই তাৎপর্য অনুযায়ী এই আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় ইহাই যে, পূর্ববর্তী সূরার ৫৮ আয়াতে অবিশ্বাসী আরব জাতির ধ্বংস প্রাপ্তির যে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হইয়াছে উহার সময় আসিয়া গিয়াছে। ‘আস্ সায়াত’ (নির্দিষ্ট মুহূর্ত) বলিতে এখানে সন্নিহিত সময়ে অনুষ্ঠিতব্য বদরের যুদ্ধের কথাই বলা হইয়াছে, যে যুদ্ধে কুরায়শদের প্রায় সকল নেতা ও প্রধানগণ মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল এবং এইভাবে তাহাদের ক্ষমতা-বিলয়ের ভিত্তি রচিত হইয়াছিল। অতএব, এই আয়াতটি একটি মহা ভবিষ্যদ্বাণীর মর্যাদায় সমাসীন, যাহা ঘোষণার আট-নয় বৎসরের মধ্যেই সগৌরবে পূর্ণ হইয়াছিল। উপরন্তু, অনেক লেখকের মতে ‘ইন্‌শাক্কাল কামারু’ কথাটির অর্থ হয়, ‘ব্যাপারটা স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে’। শব্দটির এই অর্থ ধরিলে আয়াতটির অর্থ দাড়াইবে, কুরায়শদের ক্ষমতা-বিলুপ্তি ও ধ্বংসের ক্ষণ উপস্থিত হইয়া গিয়াছে এবং এখন ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিবে যে, নবী করীম (সাঃ) সত্য সত্যই আল্লাহ্‌র রসূল। ১০২৩ টীকাও দেখুন।