২৮৭৬

‘কাব’ ধনুকের ঐ অংশটিকে বলা হয় যাহা হস্তে ধরিবার স্থান হইতে বাঁকানো প্রান্তের শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত, ধনুকের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত; পরিমাপ বা স্থান। আরবগণ বলেন, ‘বাইনাহুমা কাবা কাওসাইনে’ বা ‘তাহাদের উভয়ের মধ্যে ধনুকের পরিমাপ রহিয়াছে।’ অর্থাৎ দুই জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। আরবী ভাষায় প্রবাদ আছে ‘রামাওনা আন্‌ কাউসিন, ওয়াহিদিন্‌’, যাহার শাব্দিক অর্থ হইল ‘তাহারা একই ধনুক হইতে আমাদের প্রতি তীর ছুড়িল’ অর্থাৎ তাহারা আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বা একমত হইল। এইরূপে শব্দটি ‘ঐকমত’কে বুঝাইয়া থাকে (লেইন, লিসান, যমখশরী)। ‘কাব’ শব্দের তাৎপর্য যাহাই হউক না কেন, ‘কাবা কাওসাইনে’ দ্বারা দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রগাঢ় ঐক্যের সম্পর্ককে বুঝাইয়া থাকে। এই আয়াতে ব্যক্ত করা হইয়াছে যে, মহানবী (সাঃ) তাঁহার আধ্যাত্মিক উচ্চতম গন্তব্যের দিকে, উর্দ্ধস্তর হইতে উর্দ্ধতর স্তর ক্রমাগত অতিক্রম করিতে করিতে আল্লাহ্‌তা’লার এতই নিকটে পৌঁছিয়া গেলেন যে, উভয়ের মধ্যে আর কোন দূরত্ব বাকী রহিল না, মহানবী (সাঃ) যেন দুইটি ধনুকের একই তন্ত্রী বা রজ্জতে পরিণত হইলেন। ‘দুই ধনুকের একরশি’-একটি আরবী প্রবাদ, যাহা আরবদের পুরাতন রীতি হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। দুই ব্যক্তি যখন প্রগাঢ় বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হইবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইত, তখন পুরাতন আরব-রীতি অনুযায়ী, তাহাদের দুই জনের ধনুককে একত্রে এমনিভাবে বাঁধিত যে, দুইটি ধনুক মিলিয়া একটির মতই দেখা যাইত। অতঃপর এই সম্মিলিত ধনুক হইতে দুই জনে একটি মাত্র তীরকে সম্মিলিত হস্তে ছুড়িত। ইহা দ্বারা তাহারা বুঝাইত যে, ঐ মুহূর্ত হইতে তাহারা (যেন) একীভূত হইয়া গিয়াছে, তাহাদের একের উপর আক্রমণকে অন্যজনের উপরে আক্রমণ বলিয়া গণ্য হইবে। যদি ‘তাদাল্লা’ ক্রিয়া শব্দটি আল্লাহ্‌তা’লার দিকে আরোপ করা হয় তাহা হইলে, আয়াতের অর্থ হইবেঃ মহানবী (সাঃ) আল্লাহ্‌তা’লার দিকে উর্দ্ধে গেলেন এবং আল্লাহ্‌তা’লাও মহানবী (সাঃ)-এর দিকে নিম্নে অগ্রসর হইলেন, এইভাবে অগ্রসর হইয়া, তাহারা উভয়ে মিলিত হইয়া যেন এক হইয়া গেলেন। এতদ্ব্যতীত এই আয়াতটির মধ্যে অন্য একটি সুন্দর-সূক্ষ্ম কথাও রহিয়াছে। তাহা এই যে, মহানবী (সাঃ) আল্লাহ্‌তা’লার মধ্যে নিজেকে এমনভাবে বিলীন করিয়া দিয়াছিলেন যে, তিনি স্বয়ং যেন তাহারই প্রতিচ্ছবি হইয়া গিয়াছিলেন, অপরদিকে, তিনি মানবের কাছে প্রেম-পূর্ণ হৃদয়াবেগ ও সহানুভূতিপূর্ণ মঙ্গলাকাঙ্খায় কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া মানবের কাছে এমনিভাবে অবতরণ করিলেন যে, সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যে, ‘স্রষ্টা’ ও ‘মানবতা’, এই দুই ধনুকের মধ্যে একমাত্র সংযোগ-রশিতে পরিণত হইলেন। স্বর্গ ও মর্ত মহানবী (সাঃ)-এর মধ্যে একীভূত হইল। ‘আও আদনা’—‘আরও অধিক নিকটবর্তী শব্দগুলি দ্বারা ইহাই বুঝায় যে, আল্লাহ্‌তা’লা ও মহানবী (সাঃ)-এর মধ্যেকার সম্পর্কের গভীরতা ও অন্তরঙ্গতা মানুষের চিন্তা ও কল্পনার অতীত। ৮ হইতে ১৮ আয়াতের মধ্যে মহানবী (সাঃ)-এর আধ্যাত্মিক উধ্ব-ভ্রমণ বা মে’রাজের বর্ণনা রহিয়াছে, যখন তিনি মহাকাশগুলিকে অতিক্রম করিয়া অতিন্দ্রিয়ভাবে আল্লাহ্‌তা’লার সমীপে নীত হইলেন এবং তাঁহার গুণাবলীর আধ্যাত্মিক জ্যোতির্বিকাশসমূহের দর্শন লাভ করিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ইহা ছিল একটি দ্বিমুখী অভিজ্ঞতা। একদিকে মহানবী (সাঃ)-এর আল্লাহ্‌র দিকে আধ্যাত্মিক উর্দ্ধ-ভ্রমণ এবং অপরদিকে তাঁহার দিকে আল্লাহ্‌তা’লার জ্যোতির্মলার অবতরণ। ‘মে’রাজ’ (আধ্যাত্মিক মহা উর্দ্ধ-ভ্রমণকে) সাধারণ মানুষের মনে, ‘ইস্‌রা’র (মহানবী সাঃ-এর রাত্রিযোগে জেরুযালেমে আধ্যাত্মিক ভ্রমণ) সহিত একাকার করা হইয়াছে। এই দুইটি পৃথক পৃথক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। ‘ইস্‌রা’ ঘটিয়াছিল নবুওয়াতের একাদশতম বা দ্বাদশতম বৎসরে আর মে’রাজের ঘটনা ঘটিয়াছিল উহার ছয়-সাত বৎসর পূর্বে, মুসলমানদের আবিসিনীয়াতে প্রথম আশ্রয় গ্রহণের অল্পকাল মাত্র পরে। এই দুইটি ঘটনার যে সব বিশদ বর্ণনা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে রহিয়াছে, সেইগুলিকে সতর্কতার সহিত পাঠ করিলে, এই অভিমত সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইবে। এই দুইটি ঘটনার স্বল্প-বিশদ আলোচনা ১৫৯০ টীকায় দেখিতে পারেন।