২৭৬৩

“এক সুস্পষ্ট বিজয়” কথাগুলি মনে হয় ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’কে বুঝাইতেছে। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, মদনী জীবনের প্রথম ছয় বছরে, যদিও মহানবী (সাঃ) তাঁহার শত্রুদের বিরুদ্ধে এত বড় বড় বিজয় অর্জন করিয়াছিলেন যে তাহাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা একেবারে পঙ্গু ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তথাপি কুরআনে ঐসব বিজয়ের একটিকেও প্রকাশ্য বিজয় বলিয়া অভিহিত করা হয় নাই। এই মহাসম্মান একমাত্র হুদায়বিয়ার সন্ধির জন্য সংরক্ষিত ছিল। অথচ এই সন্ধির শর্তগুলি বাহ্যতঃ মুসলমানদের জন্য অপমানজনক ছিল এবং ইসলামের সম্মানের প্রতি এক অসহনীয় আঘাত ছিল। এতই অসহনীয় ছিল যে, হযরত উমর (রাঃ)-এর মত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিও দুঃখে ও লজ্জায় উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, এই শর্তাবলী যদি মহানবী (সাঃ) ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি দ্বারা সম্পাদিত হইত, তাহা হইলে তিনি এইগুলিকে ঠাট্টা করিয়া উড়াইয়া দিতেন (হিশাম)। প্রকৃতপক্ষে, নিশ্চিতভাবেই এই সন্ধি একটি মহাবিজয় ছিল, এই কারণে যে, ইহা ইসলামের বিস্তৃতি, প্রচার ও প্রসারের পথ অবারিতভাবে খুলিয়া দিল, যাহার ফলে মক্কার পতন ও সারা আরবের বিজয়ের চাবি মুসলমানের হাতে আসিয়া গেল। মহানবী (সাঃ)-এর জন্য এই সন্ধিটি ছিল মহাকুশলীর বিজয়-চাল, যাহার ফলে তাঁহার ‘রাজনৈতিক মর্যাদা, কুরায়শদের স্বাধীন ও সার্বভৌম মর্যাদার সমানই স্বাধীন ও সার্বভৌম বলিয়া স্বীকৃত হইয়া গেল’ (মোহাম্মদ এ্যাট মেডিনা বাই মন্টগোমারী ওয়াট)। মহানবী (সাঃ) স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার একদল সঙ্গী লইয়া কাবা গৃহের তাওয়াফ করিতেছেন। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিবার জন্য তিনি ১,৫০০ জন সাথী লইয়া উমরা (৬২৮ইং) সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সেই পবিত্র মাসগুলির মধ্যে রওয়ানা হইলেন, যে মাসগুলিতে ইসলামের পূর্ব হইতেই আরবদেশের প্রচলন ও রীতি অনুযায়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। তিনি যখন মক্কার কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ‘উসূফান’ নামক স্থানে পৌছিলেন, যখন তিনি তাঁহার পূর্বে-পাঠানো দূতের মারফত অবহিত হইলেন যে, কুরায়শগণ কোন অবস্থাতেই মহানবীকে মক্কায় প্রবেশ করিতে দিবে না। এই অগ্রদূত দলের নেতা ছিলেন আব্বাদ বিন বিশর। যুদ্ধ পরিহার করার মানসে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) রাস্তা পরিবর্তন পূর্বক, বহু দুর্গম ও কষ্টকর প্রস্তরময়, পেঁচালো দীর্ঘপথ ঘুরিয়া হুদায়বিয়াতে পৌছিলেন এবং তাবু ফেলিলেন। মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করিলেন যে, পবিত্র মক্কার সম্মানের খাতিরে তিনি কুরায়শদের সকল শর্ত মানিতে প্রস্তুত আছেন (হিশাম)। কুরায়শগণ দৃঢ় সঙ্কল্প ছিল যে, মহানবী (সাঃ) যাহা কিছুই বলুন না কেন, তাহারা কোন ক্রমেই তাঁহাকে মক্কায় প্রবেশ করিতে দিবে না। উভয় পক্ষে বহু বাণী আদান-প্রদান করা হইল, যাহাতে সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হইয়া যায়। বহু তর্ক-বির্তক ও সুদীর্ঘ সংলাপ সত্বেও ফলপ্রসূ কিছুই ঘটল না। মহানবী (সাঃ) নিজের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও মান-সম্মানকে উপেক্ষা করিয়াও কুরায়শদের সহিত একটা ন্যায়-সঙ্গত আপোষে উপনীত হইবার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অসীম ধৈর্যের সাথে প্রচেষ্টা চালাইয়া গেলেন। শেষ পর্যন্ত একটা আপোষ-মীমাংসা হইল বটে, কিন্তু চুক্তির শর্তগুলি মুসলমানদের জন্য তত সুবিধাজনক বোধ হইতেছিল না। শর্তগুলি এইরূপঃ “দশ বৎসরের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ স্থগিত করা হইল। যাহারা মহানবী (সাঃ)-এর পক্ষাবলম্বন করিতে চায় কিংবা তাহার সহিত সন্ধি স্থাপন করিতে চায়, তাহাদিগকে অবাধে তাহা করিতে দেওয়া হইবে। অনুরূপভাবে যাহারা কুরায়শদের পক্ষাবলম্বন করিতে চাহিবে কিংবা তাহাদের সাথে সন্ধি স্থাপন করিতে চাহিবে, তাহারাও তাহা অবাধে করিতে পারিবে। মৈত্রী-জোট গঠনে কোন প্রকার বাধা দেওয়া যাইবে না। যদি কোন মো’মেন ব্যক্তি অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে মক্কা ছাড়িয়া মহানবী (সাঃ)-এর কাছে গমন করে, তাহা হইলে ঐ মুসলিম ব্যক্তিকে মক্কায় তাহার অভিভাবকের কাছে ফেরৎ পাঠাইতে হইবে। কিন্তু মহানবী (সাঃ)-এর কোন অনুসারী যদি তাঁহাকে ছাড়িয়া কুরায়শদের কাছে চলিয়া আসে তাহা হইলে তাহাকে ফেরৎ চাওয়া যাইবে না বা ফেরৎ দেওয়া হইবে না। এই বৎসর মক্কানগরীতে প্রবেশ না করিয়াই মহানবী (সাঃ)-কে মদীনায় ফিরিয়া যাইতে হইবে। অবশ্য পরবর্তী বৎসরে তিনি তাঁহার সার্থীগণকে সঙ্গে নিয়া ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় তিনদিন ধরিয়া অবস্থান করিতে পারিবেন, তবে তাহারা কোষাবদ্ধ তরবারী ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের অস্ত্র সঙ্গে আনিতে পারিবেন না।” শর্তগুলির দিকে তাকাইলেই মনে হয় যে, এইগুলি অপমানজনক। মুসলমানরা খুবই মনক্ষুন্ন হইলেন। তাহাদের মনের গভীর দুঃখানুভূতি ও অপমানবোধ ভাষায় প্রকাশ করা সুকঠিন। তৃতীয় শর্তটি একেবারে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু মহানবী (সাঃ) শান্ত ও সমাহিত। কেননা, ইসলামের নৈতিক শক্তির উপর তাহার এত গভীর আস্থা ছিল যে, তিনি নিশ্চিত প্রত্যয় রাখিতেন, যে ব্যক্তি একবার ঈমানের স্বাদ লাভ করিয়াছে, সে ঐ ঈমানের খাতিরে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া পসন্দ করিবে, তথাপি কুফরীর মধ্যে প্রত্যাবর্তন করিবে না (বুখারী)। তাহা ছাড়াও, সে যেখানেই থাকুক না কেন ইসলামের জন্য এক শক্তির উৎসরূপেই থাকিবে। পরবর্তীকালে এই সন্ধিই একটি ‘প্রকাশ্য বিজয়’ বলিয়া প্রমাণিত হইল। মহানবী (সাঃ)-এর যে সকল সাহাবী এই সন্ধি স্থাপনের কালে হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন, তাহারা অত্যন্ত গৌরব বোধ করিতেন এবং যথেষ্ট ন্যায়-সঙ্গতভাবেই বলিতেন যে, এই আয়াতের “সুস্পষ্ট বিজয়” বলিতে মক্কা বিজয়কে নয়, বরং হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বুঝাইতেছে (বুখারী) তাহাদের মতে অন্য কোন বিজয়ই পরিণামের দিক দিয়া এই সন্ধির চাইতে বড় ও ফলপ্রসূ সাব্যস্ত হয় নাই (হিশাম)। আর, নবী করীম (সাঃ) স্বয়ং ইহাকে মহাবিজয় বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন (বায়হাকী)। কুরআন ইহাকে বলিয়াছে, এক সুস্পষ্ট বিজয় (আয়াত-২), মহাসফলতা (আয়াত-৬) মহাপুরস্কার (আয়াত-১১), নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি আল্লাহ্‌তা’লার পূর্ণতম অনুগ্রহ (আয়াত-৩)। কারণ, এই সন্ধিই ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ও বিজয়সমূহের সদর দরজা খুলিয়া দিয়াছিল।