২৩৪৩

নবী করীম (সাঃ)-এর জীবনের অন্তহীন পরীক্ষার মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন ও কঠোর পরীক্ষা ছিল এই খন্দকের যুদ্ধ। এই কঠোরতম পরীক্ষা হইতে সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে, তাঁহার নৈতিক স্তর ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়া গেল। মানুষের মনের প্রকৃত পরিচয়, তাহার মাহাত্ম্য বা নীচতা, তখনই সঠিকভাবে প্রকাশিত হয় যখন সে মহাবিপদে বা ঘোর অন্ধকারে নিপতিত হয় অথবা যখন সে নিজের শত্রুকে স্বীয় পদতলে ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় দেখিয়া কৃতকার্যতা ও বিজয়ের গৌরব অর্জন করে। ইতিহাস এই কথার ভূরি ভূরি সাক্ষ্য প্রমাণে ভরপুর যে, মহানবী (সাঃ) স্বীয় সংকট মুহূর্তে যেমনি মহান ও মহীয়ান ছিলেন, স্বীয় কৃতকার্যতা ও বিজয় মুহূর্তেও তেমনি মহান ও মহীয়ান ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ ও হুনায়নের যুদ্ধ তাঁহার সুমহান চরিত্রের এক বিশিষ্ট দিকে যেমন ব্যাপকভাবে আলোক সম্পাত করে, তেমনি মক্কা-বিজয় তাঁহার চরিত্রের অন্য বিশিষ্ট দিকের প্রতি ব্যাপকভাবে আলোক সম্পাত করে। সম্পদে-বিপদে, জয়-পরাজয়ে তিনি সমভাবে মহান ও মহীয়ান। সংকট ও বিপদ তাঁহাকে হতাশ বা মূহ্যমান করে নাই,আবার কৃতকার্যতা ও বিজয় তাঁহাকে গর্বিত করে নাই। হুনায়নের যুদ্ধের দিনে যখন তিনি প্রায় একাকী রণাঙ্গণে ছিলেন এবং ইসলামের অস্তিত্ব প্রায় মিটিয়া যাইবার মত হইল, তখনও তিনি নির্ভয়ে নিদ্ধিধায় শত্রুব্যূহে একা প্রবেশ করিলেন, আর তাঁহার পবিত্র মুখে বীরত্বভরে উচ্চারিত হইল—‘আমি নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র নবী, আমি মিথ্যা বলিতেছি না। আমি আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র।’ আর যেদিন মক্কা বিজয়ের সাথে, সারা আরব ভূমি তাঁহার পদতলে প্রণত হইল, তখন অবিসংবাদিত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হইয়াও তিনি গর্বিত ও উদ্ধত হইলেন না। তিনি শত্রুর প্রতি ক্ষমা ও মাহাত্ম্য প্রদর্শন করিলেন। মহানবী (সাঃ)-এর চরিত্র-মাহাত্ম্যের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল সাক্ষ্য ইহাই যে, যাহারা তাঁহার নিত্য সাথী ছিলেন এবং তাঁহাকে সর্বাপেক্ষা বেশী ঘনিষ্ঠভাবে চিনিতেন, তাহারা প্রত্যেকেই বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁহার দাবীর সাথে সাথে তাঁহাকে সত্যনবী বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা হইলেন, মহানবী (সাঃ)-এর স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁহার জীবনব্যাপী বন্ধু হযরত আবুবকর (রাঃ), তাঁহার চাচাত ভাই হযরত আলী (রাঃ) এবং তাঁহার মুক্তিপ্রাপ্ত কৃতদাস হযরত যায়েদ (রাঃ)। মহানবী (সাঃ) ছিলেন উচ্চতম মানবতার প্রতীক। তিনি (সাঃ) ছিলেন সুন্দরের, কল্যাণের ও পরহিতের মহোত্তম আদর্শ। তাঁহার বৈচিত্র্যময় জীবনের ও মহান চরিত্রের যে কোন দিকে তাকাইয়া দেখুন, তিনি অনুপম তিনি মানবতার জন্য অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ও আদর্শ। তিনিই সর্বাধিক অনুসরণযোগ্য। তাঁহার জীবন, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত, উন্মুক্ত ইতিহাসের মত পাতায় পাতায় বর্ণিত। তিনি এক এতীম (পিতামাতাহীন) বালক হিসাবে জীবন আরম্ভ করেন এবং সমগ্র জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা হিসাবে জীবন সমাপ্ত করেন। বালক বয়সে তিনি ছিলেন শান্ত, গম্ভীর ও মর্যাদাবান। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন নীতিবান, চারিত্রিক গুণাবলীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ন্যায় ও গাম্ভীর্যের মূর্ত প্রতীক। মধ্য বয়সে তিনি হইলেন তাহাদের সকলের কাছে ‘আল আমীন’ (বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী)। ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি ছিলেন বিবেক-বিবেচনা ও সততার শীর্ষে। তিনি অধিক বয়স্কা ও অল্প বয়স্কার পানিগ্রহণ করিলেন এবং তাহারা সকলেই শপথ-পূর্বক তাহার বিশ্বস্ততা, ভালবাসা, পবিত্রতা ও মহত্বের সাক্ষ্য দান করিলেন। পিতা হিসাবে তিনি ছিলেন অতিশয় স্নেহশীল, বন্ধু হিসাবে ছিলেন বিশ্বস্ত ও বিবেচনাশীল। একটি অধঃপতিত পাপাচারী সমাজের সংস্কারের কঠিন গুরুদায়িত্বের বোঝা যখন তাহার কাধে চাপিল এবং এই কারণে অত্যাচারিত ও নির্বাসিত হইলেন, তখন তিনি মোটেই দমিলেন না, বরং অত্যন্ত ধৈর্য, স্থৈর্য ও মর্যাদার সহিত তাহা বরণ করিয়া লইলেন। তিনি সাধারণ সৈন্যরূপে যুদ্ধ করিয়াছেন, আবার বড় বড় সেনা-বাহিনীকে পরিচালনাও করিয়াছেন। তিনি পরাজয় বরণ করিয়াছেন, বিজয়ীও হইয়াছেন। তিনি আইন-প্রণয়ন করিয়াছেন, আবার বিচারকের কাজও করিয়াছেন। তিনি ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রনীতিবিদ, শিক্ষাদাতা ও মানুষের নেতা। “রাষ্ট্রপতি ও ধর্মাধিপতিরূপে তিনি ছিলেন একাধারে সীজার ও পোপ। কিন্তু তিনি পোপ হওয়া সত্ত্বেও পোপের ভূষণ-ভড়ং কিছুই তাঁহার ছিল না। তিনি সীজার ছিলেন বটে, কিন্তু সীজারের রাজদণ্ড তাঁহার ছিল না। নিয়মিত সেনাবাহিনী ছাড়া, নিয়মিত দেহ-রক্ষী ছাড়া, নিয়মিত রাজস্ব ও রাজপ্রাসাদ ছাড়া যদি কোন মানুষের একথা বলিবার অধিকার থাকে যে, তিনি ঐশী অধিকার বলে শাসন করিয়াছেন, তবে সেই অধিকার একমাত্র মুহাম্মদ (সাঃ)-এরই রহিয়াছে। কেননা তিনি সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী ছিলেন, যদিও ক্ষমতা প্রয়োগের সকল যন্ত্র ও ব্যবস্থাপনা তাহার হাতে মোটেই ছিল না। তিনি নিজ হাতে গৃহকর্ম করিতেন, চামড়ার মাদুরে শয়ন করিতেন। দৈনিক কয়েকটি খেজুর কিংবা বালি-রুটি মাত্র পানিসহ খাইতেন। সারাদিনব্যাপী নানাবিধ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের পর, রাত্রির প্রহরগুলি তিনি দোয়া ও প্রার্থনায় কাটাইয়া দিতেন। এমন কি, দাঁড়াইয়া দীর্ঘ সময় ব্যাপী দোয়া করিতে করিতে তাহার পায়ের পাতা ফুলিয়া যাইত। বিশ্বে এমন কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই যিনি এতসব পরিবর্তিত অবস্থা ও অবস্থানের ভিতর দিয়া জীবন কাটাইয়াছেন অথচ নিজে সামান্য পরিবর্তিত হন নাই।” (মুহাম্মদ এণ্ড মুহাম্মদানিজমঃ বসওয়ার্থ স্মীথ)।