আয়াতটি একটি চমৎকার রূপক। ইহা তিনটি বিষয়ের প্রকাশক— প্রদীপ, কাঁচের চিমনি এবং দেওয়াল গাত্রস্থ কোটর বা তাক। ঐশী পবিত্র আলো এই তিনটি জিনিসের মধ্যে সীমাবন্ধ, যাহা রূপকে বর্ণিত হইয়াছে, সেগুলি একত্রিত হইলে ইহার ঔজ্জ্বল্য এবং দীপ্তি পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। প্রদীপ হইল আলোর যথার্থ উৎস, কাঁচের চিমনি যাহা প্রদীপের ঢাকনা স্বরূপ দমকা বাতাসের ঝাপটায় নিভিয়া যাওয়া হইতে ইহার আলোককে রক্ষা করে এবং ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে এবং দেওয়াল-গাত্রের ফোঁকর আলোককে সুরক্ষিত করে। এই উপমা বৈদ্যুতিক টর্চের সঙ্গে যথাযথভাবে তুলনীয়, যাহার অপরিহার্য অংশগুলি হইতেছে বৈদুতিক তার যাহা আলো প্রজ্বলিত করে, বালু ইহাকে সুরক্ষিত করে এবং প্রতিফলক আলোককে বিস্তৃত ও বিকীর্ণ করে এবং পরিচালন করে আধ্যাত্মিক পরিভাষায় তিনটি বস্তু—‘প্রদীপ’, ‘কাঁচের চিমনি’ এবং ‘দেওয়াল গাত্রস্থ কোটর’ – যথাক্রমে প্রদীপ অর্থাৎ ঐশী নূর বা আলো, আল্লাহ্তা’লার প্রেরিত-নবী রসূলগণ হইতেছেন কাঁচের চিমনি স্বরূপ যাহারা সেই নূরকে বিলুপ্তি হইতে সুরক্ষিত করেন এবং আলোর বিস্তার ও ঔজ্জ্বল্যকে বৃদ্ধি করেন এবং মিশকাত অর্থাৎ দেওয়াল-কোটর হইতেছে নবীদের খলীফা বা প্রতিনিধিগণ, যাহারা এই ঐশী আলো বিকীর্ণ করেন ও প্রচার করেন এবং জগদ্বাসীকে পথ-প্রদর্শনের জন্য এবং আলোকিত করার লক্ষ্যে পরিচালনা করেন। এই আয়াত আরো ঘোষণা করে যে, প্রদীপ জ্বলিতে ব্যবহৃত তৈল (যয়তুন) এরূপ নির্ভেজাল ও সহজ দাহ্য যে, না জ্বলিলেও ইহাতে (তৈল) অকস্মাৎ শিখা বিস্ফোরিত হয়। এই তৈল এক প্রকার বৃক্ষের নির্যাস হইতে প্রস্তুত—সেই বৃক্ষ যাহা না প্রাচ্যের না পাশ্চাত্যের, ইহা কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতির পক্ষে বা বিপক্ষে বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। এই আয়াতের অন্য এক ব্যাখ্যাও হইতে পারে। আয়াতে বর্ণিত নূর বা আলো পবিত্র নবী করীম (সাঃ)-এর জন্য ব্যবহৃত বলিয়া ধরিয়া নেওয়া যাইতে পারে, কারণ কুরআনে তাঁহাকে নূর হিসাবে অভিহিত করা হইয়াছে (৫ঃ১৬)। এই অর্থে দেওয়াল গাত্রস্থ কোটরীর মর্ম হইবে নবী করীম (সাঃ)-এর হৃদয় এবং প্রদীপ তাঁহার সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও নিষ্কলংক স্বভাব যাহা সর্বোৎকৃষ্ট ও মহোত্তম সদগুণাবলীর দ্বারা সমৃদ্ধ এবং কাঁচের মর্মার্থ এই যে, পবিত্র আলো যদ্বারা তাঁহার চরিত্র বিভূষিত করা হইয়াছে তাহা স্ফটিকের ন্যায় স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। যখন আল্লাহ্তা’লার ওহীর নূর নবী করীম (সাঃ)-এর স্বভাবের আলোর উপর নামিয়া আসিত, তখন উহা দ্বিগুণ তুল্য আলোর বন্যা হইয়া উদ্ভাসিত হইত, যাহাকে কুরআনের ভাষায় ‘নুরুন আলা নূর’ অর্থাৎ আলোর উপরে আলোতুল্য বর্ণিত হইয়াছে। আঁ-হযরত (সাঃ)-এর এই নূর পরিপুষ্ট হইত এক প্রকার তৈল দ্বারা যাহা পবিত্র বলিয়া ঘোষিত এক প্রকার বৃক্ষ হইতে উদ্ভূত হইয়াছিল অর্থাৎ রসূল করীম (সাঃ)-এর নূর কেবল উজ্জ্বল ও দীপ্তমানই ছিল না, অধিকন্তু প্রচুর ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত এবং অনন্ত ছিল (যেমন ‘মুবারাকা’ শব্দে বুঝায়) এবং লক্ষ্য ছিল প্রাচ্য এবং প্রাশ্চাত্য উভয়কে আলোকিত করা। তদুপরি, মহানবী (সাঃ)-এর হৃদয় এতই পবিত্র ছিল এবং তাঁহার প্রকৃতি এরূপ সহজাত মহৎ গুণসম্পন্ন ছিল যে, পবিত্র ওহীর নূর তাঁহার উপর অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই মহৎ প্রচার কার্যের দায়িত্ব পালনে তিনি প্রায় উপযুক্ত ছিলেন। ইহাই হইতেছে ‘উহার তৈল এমন যেন এক্ষণই উহা স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে জ্বলিয়া উঠিবে যদিও অগ্নি উহাকে স্পর্শ না করে’ উক্তিটির অন্তর্নিহিত মর্ম। এই রূপকের আরো একটি ব্যাখ্যা থাকিতে পারে। আয়াতের ‘দেওয়াল কোটর’ মানুষের শরীরকে বলা যায়। মানবদেহ আপন অভ্যন্তরে সাহস বা কর্মশক্তি ধারণা করে যাহা দেহের ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে নিজকে সৃষ্টি করিয়া প্রকাশ করে। দেওয়াল-কোটরীর মতই মানুষের দেহ আলোরূপ শক্তিকে সংরক্ষিত করে এবং ইহার অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে। অর্থাৎ মানবদেহ ‘মিসবাহ’ বা আত্মার প্রদীপটি ধারণ করে যাহা মানবের অন্তরকে আলোকিত করে এবং ইহাকে আল্লাহ্তা’লার সংস্পর্শে আনয়ন করে। এই প্রদীপটি একটি ‘যুজাজাতে’ (কাচের গ্লোব বা চিমনিতে) রক্ষিত, যাহা ইহাকে ক্ষতি এবং অমঙ্গল হইতে রক্ষা করে এবং ইহার উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত করে। এই ‘যুজাজাহ্’ বা কাঁচরাপী মানবমস্তিষ্কের গঠন প্রণালী এতই নিখুঁত যে, কোন কোন দার্শনিক এইরূপ চিন্তা করিয়াছেন যে, ইহাই ঐশী আলোর চরম উৎস। এক পবিত্র যয়তুন বৃক্ষ হইতে উদ্ভূত তৈল দ্বারা। অর্থাৎ ঐ সমস্ত মৌলিক এবং পরম সত্য দ্বারা এই আলো বাঁচিয়া থাকে, যেগুলি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য জাতিগুলির কাহারও একচেটিয়া নহে। এই চিরসত্যগুলি কাহারও একচেটিয়া নহে। এই চিরসত্যগুলি মানবের প্রকৃতির মধ্যেই রোপিত রহিয়াছে এবং এমন কি আল্লাহ্তা’লার ওহী-ইলহামের সাহায্য ব্যতিরেকেও ঐগুলি প্রায় প্রকাশমান হইয়া থাকে।