যুল-কিফলের পরিচয় অনিশ্চয়তার তিমিরে আচ্ছাদিত। কুরআনের মুসলমান ব্যাখ্যাকারীগণ পৃথক পৃথক একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁহার পরিচিতি সম্পৃক্ত করিয়াছেন, প্রধানতঃ বাইবেলে উল্লেখিত কয়েকজন নবীর সঙ্গে। কিন্তু এই নামে পরিচিত নবী মনে হয় যিহিষ্কেল (Ezekiel) যাহাকে আরবরা যুল-কিফল নামে অভিহিত করিয়া থাকে। যুল-কিফল (Hizqel) এবং যিহিষ্কেল (Ezekiel) এই দুই শব্দের মধ্যে উভয়ের আকার এবং অর্থে অতি নিকট সাদৃশ্য বিদ্যমান। প্রথমোক্ত শব্দের অর্থ প্রচুর অংশের অধিকারী এবং শেষোক্ত শব্দের অর্থ আল্লাহ্ শক্তি দান করেন। রডওয়েল বলিতেন যে, আরবরা যিহিষ্কেলকে যুল-কিফল বলিয়া থাকে। কারষ্টেন নিইবুহর (Karsten Niebuhr)-এর মতে, নাযাফ এবং হিল্লা (বেবিলন)-এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কিফল নামে পরিচিত ছোট শহরে যিহিষ্কেলের সমাধি রহিয়াছে, যাহা আজও ইহুদী তীর্থযাত্রীগণের দর্শনীয় স্থান। তিনি ইহাও মনে করেন যে, যিহিষ্কেলের আরবী শব্দরূপ যুল্ কিফল। ইহুদীগণও যিহিষ্কেলকে যুল কিফল বলিয়াই বিশ্বাস করিয়া থাকে (যুল-কিফল অধ্যায়—এনসাইক অব ইসলাম এবং নিসবুহারর্ক ট্রাভেল, ২য় খণ্ড ২৬৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। সম্ভবতঃ খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৬২২ অব্দে যাজক পরিবারে তাঁহার জন্ম। যুল-কিফল তাঁহার জীবনের প্রথম ২৫ বৎসর অতিবাহিত করিয়াছিলেন যোধায়। ৫৯২ খৃঃ পূর্বাব্দে ত্রিশ বৎসর বয়সে আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হন এবং তাঁহার জাতির মূর্তিপূজা, অবিচার এবং অসচ্চরিত্রতার বিরুদ্ধে প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। ইতিমধ্যে পশ্চিম এশিয়ায় অ্যাসিরিয়ার স্থলে ব্যাবিলন ক্ষমতাশালী শক্তিরূপে পরিগণিত হয় এবং যোধা উহার উর্দ্ধতম কর্তৃত্বকে স্বীকার করিয়া নেয়। কিন্তু যোধার রাজা যেহোইয়াকিম (Jehoiakim), তাহার অসৎ পরিষদবর্গের পরামর্শের প্রভাবাধীনে ব্যাবিলনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এইভাবে নিজের উপরে নেবুখদ-নিৎসরের প্রতিহিংসা ডাকিয়া আনে। সে ৫৯৭ খৃষ্ট পূর্বাব্দে সফলতার সঙ্গে যেরুজালেম অবরোধ করে এবং উহার অনেক নেতৃস্থানীয় নাগরিকদিগকে বন্দী করিয়া নিয়া যায়, সেই সঙ্গে যিহিষ্কেল এবং যেহোইয়াকিমের পুত্র, মাত্র ৩ মাসের অন্তবর্তীকালে রাজা যেহোইয়াচিম (Jehoiachim) কেও বন্দী করিয়া নিয়া যায়। যেহোইয়াচিমের চাচা সিদিকিয়া (zedekieah) তাহার স্থলাভিষিক্ত রাজা হন। কিছুকালের জন্য সে ব্যবিলনের প্রতি অনুগত ছিল, কিন্তু মিশরের সাহয্যের উপর নির্ভর করিয়া সে ব্যাবিলনের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে। এই কাজে যিহিষ্কেল অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হইয়া উঠেন এবং ইহাকে ইয়াহওয়েহ (Yahweh)-এর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়া প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন। ফলশ্রুতিতে নেবুখদ-নিৎসর কর্তৃক যেরুজালেম অধিকৃত হয় এবং আঠার মাস অবরোধের পর ইহাকে অবর্ণনীয় আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে ধ্বংস করিয়া দেয়। যে উপাসনালয়ের উপরে শ্রদ্ধা-ভক্তির গভীর আবেগ অর্পিত ছিল উহাকে ভস্মম্ভপে পরিণত করা হয় এবং উহার লোকদিগকে ব্যাবিলনে নির্বাসিত করা হয় (৫৮৬ খৃঃ পূঃ অব্দ)। এই ছিল অবস্থা যাহা যিহিষ্কেলকে সংগ্রামের মুখোমুখি করিয়াছিল। পতনের পাঁচ বৎসর পূর্বে ৫৯২ খৃঃ পূঃ সনে তিনি দিব্য-জ্ঞানে কিছু জানিতে পারিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন এবং ইহুদী জাতিকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন। ৫৯৭ খৃঃ ব্যাবিলন কর্তৃক প্রথম প্রচণ্ড আঘাতেই রাজনৈতিকভাবে ইহুদী জাতির আসন্ন অবলুপ্তির সম্ভাবনা সম্বন্ধে প্রত্যয়পূর্ণ বোধোদয় ঘটে নাই— যে সম্ভাবনা যিহিষ্কেলের নিকট ছিল দ্বিপ্রহরের মতই দেদীপ্যমান। কিন্তু যেমন তিনি ইহুদী জাতির ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, তেমনি তাহাদের পুনঃস্থাপনের আগাম সংবাদও দিয়াছিলেন, তাহার জাতির অধঃপতনের ভবিষ্যদ্বাণী যেমন কঠোর ছিল, তেমনই তাহাদের ভাগ্যে মুক্তির এক মহান এবং উজ্জ্বল চিত্রও আঁকিয়াছিলেন। তাহাদের উদ্ধার এবং যেরুজালেমে প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে তাঁহার এই ভবিষ্যদ্বাণী কাশ্ফ-ভিত্তিক ছিল, যাহা তিনি দেখিয়াছিলেন (যিহিষ্কেল-৩৭) এবং এই সম্বন্ধে কুরআনেও ২ঃ২৬০ আয়াতে উল্লেখ রহিয়াছে। কিন্তু তাঁহার এই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা স্বচক্ষে দেখিয়া যাইতে তিনি দীর্ঘ দিন বাঁচিয়া ছিলেন না, কারণ বন্দী অবস্থায় খৃঃ পূঃ ৫৭০ সনে ৫২ বৎসর বয়সে তিনি পরলোক গমন করিয়াছিলেন। যিহিষ্কেল এবং দানিয়েলকে নির্বাসিত নবী বলা হইয়া থাকে (The Holy Bible, edited by Rev. Sc.১. Cofield & Peaks ’Commetary of the Bible’)।