ইয়া’জুজ এবং মা’জুজ (গগ এণ্ড ম্যাগগ) শব্দদ্বয় মূল শব্দ ‘আজ্জা’ হইতে উৎপন্ন, ইহার অর্থ তাহার পদক্ষেপ দ্রুত ছিল, সে অগ্নিশিখায় পরিণত হইল (লেইন) এবং ইহা দ্বারা নির্দেশ করে দূর প্রাচ্যের সিদিয়ার লোক অথবা যেমন কেহ কেহ বলেন, উত্তর এশিয়া ও ইউরোপে বসবাসকারী জাতিসমূহ (এনসাইক, ব্রিট এবং যিউ এনসাইক, ‘গগ ও মাগগ’ অধ্যায় এবং হিষ্টরিয়ানস্ হিষ্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড, ২য় খণ্ড, ৫৮২ পৃষ্ঠা, এবং যিহিষ্কেল ৩৮ঃ২-৬ ও ৩৯ঃ৬)। এই শব্দগুলি পাশ্চাত্যের খৃষ্টান জাতিসমূহের জন্য প্রয়োগ হইতে পারে, যেহেতু তাহারা জলন্ত অগ্নিকুণ্ড এবং ফুটন্ত জলধারা অধিক পরিমাণে ব্যবহার করিয়াছে এবং এই সমস্ত জড় বস্তুর ব্যাপক ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তাহাদের সর্বপ্রকার পার্থিব উন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সম্ভব হইয়াছে। অথবা এই সকল জাতিগুলির অস্থির আচরণ, যেমন তাহারা সর্বদাই অধৈর্য এবং অস্থিরভাবে নূতন জয়ের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে, উহা এই ইংগিতও বহন করিতে পারে। ইয়া’জুজ-মা’জুজ সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনা মতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইহা পাশ্চাত্যের কোন খৃষ্টান শক্তির প্রতি আরোপিত বা সংশ্লিষ্ট। প্রথমতঃ তাহারা বহু সংখ্যক শক্তিশালী এবং প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাবানঃ ‘কিন্তু তুমি উঠিবে, ঝঞ্ঝার ন্যায় আসিবে, মেঘের ন্যায় তুমিও তোমার সহিত তোমার সকল সৈন্যদল ও অনেক জাতি সেই দেশ আচ্ছাদন করিবে।’ (যিহিষ্কেল ৩৮ঃ৯,) (গগ এণ্ড ম্যাগগ) ইয়া’জুজ মা’জুজ…… তাহাদের সংখ্যাসমূহের বালুকার তুল্য (প্রকাশিত বাক্য-২০ ঃ৮)। তোমরা বীরগণের মাংস খাইবে ও ভূপতিদের রক্ত পান করিবে’ (যিহিষ্কেল-৩৯ঃ১৮, ১৯)। দ্বিতীয়তঃ পৃথিবীর উত্তরাঞ্চল এবং দীপাঞ্চল হইতে তাহাদের আগমন দেখান হইয়াছেঃ “আর তুমি আপন স্থান হইতে উত্তর দিকের প্রান্ত হইতে আসিবে এবং অনেক জাতি তোমার সংগে আসিবে তাহারা সকলে ঘোড়ায় চড়িয়া আসিবে’ (যিহিষ্কেল ৩৮ঃ১৫)। তৃতীয়ত তাহারা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িবেঃ “তাহারা পৃথিবীর বিস্তার দিয়া আসিয়া পবিত্রগণের শিবির এবং প্রিয় নগরটি ঘেরিল,তখন স্বর্গ হইতে অগ্নি পড়িয়া তাহাদিগকে গ্রাস করিল’ (প্রকাশিত বাক্য-২০ঃ৯)।চতুর্থতঃ উত্তরাঞ্চলে তাহাদের আবাসস্থল হইতে দেশান্তরে চলিয়া যাইবে এবং পৃথিবীর চতুর্দিকে স্থায়ী বসবাস স্থাপন করিবে এবং যুদ্ধ বাঁধিলে তাহারা তাহাদের দূরবর্তী উপনিবেশগুলি হইতে আসিয়া একত্রে মিলিত হইবে। শয়তানকে তাহার কারা হইতে মুক্ত করা যাইবে। তাহাতে তো পৃথিবীর চারিকোণস্থিত জাতিগণকে ও গগ ও ম্যাগগকে ভ্রান্ত করিয়া যুদ্ধে একত্র করিবার জন্য বাহির হইবে’ (প্রকাশিত বাক্য-২০ঃ৮)। যিহিষ্কেল নবীর গ্রন্থে ইয়া’জুজকে ‘হে মনুষ্য সন্তান, তুমি রোশের, মেশকের ও তুবালের অধ্যক্ষ’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, রোশ হইতেছে রাশিয়া, মেশক মস্কো এবং তুবাল টবোলস্ক। গগ (ইয়া’জুজ) কে মাগগ বা মা’জুজের দেশীও বলা হইয়াছে (যিহিষ্কেল ৩৮ঃ২)এবং বাইবেলের ব্যাখ্যাকারীগণের মতে ম্যাগগ বা মা’জুজ সেই এলাকা নির্দেশ করে যাহা প্রাচীন মতে সিদিয়া (রাশিয়া এবং তাতারসহ) নামে পরিচিত, যে স্থান হইতে অতীতে অনেক বর্বর যাযাবর দল উত্থিত হইয়াছিল। রাশিয়া যেহেতু মা’জুজের দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেই কারণে রোশ, মেশক এবং তুবালকে যথাক্রমে রাশিয়া, মস্কো এবং টবোলস্ক বলিয়া ধরা যায়। ম্যাগগ বা মা’জুজকে এক জাতির নাম বলিয়া যিহিষ্কেল ৩৯ঃ৬-তে এবং প্রকাশিত বাক্য-২০ঃ৮তে বলা হইতেছে। প্রথমোক্ত যিহিষ্কেল-৩৯ঃ৬তে মাজুজকে যাহারা উপকূল নিবাসী তাহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছে। এই সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতেই ইয়া’জুজ এবং মা’জুজ (গগ এণ্ড ম্যাগগ) রাশিয়াসহ ইউরোপের কতক বৃহৎ শক্তিকে নির্দেশ করে। কুরআন করীমে ১৮ঃ৯৫ আয়াতে ইরানের উত্তর সীমান্তের রাজ্যসমূহে তাহাদের আক্রমণের সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, যদ্বারা ইহা প্রতিপন্ন হয় যে, এই সকল উপজাতিরাই সাধারণতঃ সিদিয়ান (Seythians) নামে পরিচিত ছিল। ইহা এক ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা যে, অনেক পুরানকালে সিদিয়ানগণ বড় বড় দলে রাশিয়া হইতে ইউরোপের দিকে গিয়াছিল, তাহাদের গমন পথ ছিল ককেশাস পর্বতের উত্তরাঞ্চল (এনসাইক, ব্রিট, ১২ খণ্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা, ১৪শ সংস্করণ)। যখন ইউরোপে একদল অবস্থান স্থির করিয়াছিল, তখন নূতন নূতন দল পূর্বদিক হইতে আসিতে আরম্ভ করিল এবং তাহাদের পূর্বগামীদিগকে পশ্চিম হইতে আরো পশ্চিমে সরাইয়া দিল। এইরূপে ইউরোপের জাতিগুলিকে যুক্তিসঙ্গত কারণেই বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে ইয়া’জুজ এবং মা’জুজ (গগ এণ্ড ম্যাগগ) রূপে অভিহিত করা হইয়াছে। ইহা খুবই কৌতুহলোদ্দীপক যে, এই দুই বীর প্রতীকের সম্মতি আজও পর্যন্ত লন্ডন গিল্ড হলে দুই প্রতিমূর্তির আকারে সংরক্ষিত আছে। পুনঃ যিহিষ্কেল এবং প্রকাশিত বাক্যে ইহা প্রতিপন্ন হয় যে, ইয়াজুজ ও মাজুজ-এর প্রকাশিত হওয়ার কথা শেষ যুগে (আখেরী যামানায়) অর্থাৎ মসীহ (আঃ)-এর দ্বিতীয় আগমনের অব্যবহিত পূর্বে “আর তুমি মেঘের ন্যায় দেশ আচ্ছাদন করিবার জন্য আমার প্রজা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যাত্রা করিবে, উত্তরকালে এইরূপ ঘটিবে, আমি তোমাকে আমার দেশের বিরুদ্ধে আনিব যেন জাতিগণ আমাকে জানিতে পারে’ (যিহিষ্কেল-৩৮ঃ১৬ এবং প্রকাশিত বাক্য-২০ঃ৭-১০ও দেখুন)। এই আয়াতসমূহ প্রতিপন্ন করে যে, এই ভবিষ্যদ্বাণী এমন জাতির প্রতি ইশারা করিতেছে যাহারা সুদূর ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করিবে। যে যুগে ইয়া’জুজ ও মা’জুজ (গগ এণ্ড ম্যাগগ) প্রকাশিত হইবে সেই যুগ যুদ্ধ, ভূমিকম্প, মহামারী এবং ভয়ানক দৈব-দুর্বিপাক ইত্যাদি দ্বারা চিহ্নিত (দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী, ১৭১৮ – ১৭২০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।