এই আয়াত ঘোষণা করিতেছে যে, গুহার অধিবাসীবৃন্দ কোন আশ্চর্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাহাদের সম্পর্কে এমন কিছুই ছিল না যাহাকে সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলা যাইতে পারে। তাহাদিগকে কেন্দ্র করিয়া অনেক উদ্ভট কাহিনী রচনা করা হইয়াছে। উল্লেখযোগ্য গল্প হইতেছে “সেভেন স্লিপার্স” যাহা মিঃ গিবন প্রণীত “ডিক্লাইন এণ্ড ফল অব দি রোমান এম্পায়ার” পুস্তকে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। উহা গুহাবাসী সম্বন্ধে রহস্য সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র যোগান দেয়। গিবন লিখিয়াছেন “যখন সম্রাট ডিসিয়াস খৃষ্টানদিগকে নির্যাতন করিয়াছিল, এফিসাসের সাত জন অভিজাত যুবক নিকটস্থ এক প্রশস্ত গভীর গিরি-গুহাতে আত্মগোপন করিয়াছিল, সেখানেই তাহারা যালেম কর্তৃক প্রাণনাশের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত হইয়াছিল। সে হুকুম দিয়াছিল যে, গিরি-গুহার প্রবেশ পথটি বিশাল পাথরের স্তুপ দ্বারা বন্ধ করিয়া দেওয়া হউক। এখন ইহা প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক সত্য যে, প্রাথমিক যুগের খৃষ্টানগণকে তাহাদের একত্ববাদে বিশ্বাসের কারণে পৌত্তলিক রোমান সম্রাটদের হাতে অবর্ণনীয় যুলুম-নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছিল। এই অমানুষিক অত্যাচার আরম্ভ হইয়াছিল কুখ্যাত রোম সম্রাট ‘নীরু’র রাজত্বকালে, যাহার সম্বন্ধে কথিত আছে যে, সে রোম শহর আগুনে জ্বালাইয়া দিয়াছিল। সভ্যতার এবং জ্ঞানের পাদপীঠ রোম শহরে যখন আগুন জ্বলিতেছিল, নীরু তখন বাঁশী বাজাইতেছিল। এই যুলুম ও নিপীড়ন সাময়িক বিরতির পর পর চলিতেছিল। প্রায় চল্লিশ বৎসরের সংক্ষিপ্ত অবকাশের পর এই নির্যাতন প্রচণ্ড ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় নূতন করিয়া পূর্ণোদ্যমে শুরু হইয়াছিল সম্রাট ডিসিয়াসের আমলে। সে প্রাচীন রোমের ধর্মীয় অনুশাসন পুনঃ স্থাপন করিতে চাহিয়াছিল এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিয়মিতভাবে খৃষ্টানদিগকে সম্পূর্ণ ধ্বংস বা নির্মুল করা আরম্ভ করিয়াছিল।বিশেষতঃ ৩০৩খৃষ্টাব্দে ডাইওক্লিশিয়ানের (Diocletian) অনুশাসন খৃস্টানদের বিরুদ্ধে সকল মাত্রা ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এই অনুশাসনের বলে সাম্রাজ্যের সকল প্রদেশে খৃষ্টান উপাসনালয়গুলি (গির্জাসমূহ) ভাঙ্গিয়া ধ্বংস করিয়া ফেলা হইয়াছিল, তাহাদের সমস্ত পবিত্র কিতাবাদি জনসমক্ষে পোড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল, গির্জার সম্পত্তিসমূহ বাজেয়াপ্ত করা হইয়াছিল এবং খৃষ্টানদিগকে নিরাপত্তাবিহীন অবস্থায় বহিষ্কার করা হইয়াছিল (গিবনস্ রোমান এমপায়ার, এনসাইক্লো ব্রিট এণ্ড ষ্টোরি অব রোম)। এই নিষ্ঠুর ও অমানুষিক নির্যাতনের অসহায় শিকার খৃষ্টানগণ নিজদিগকে রক্ষা করিবার জন্য রোমের ভূগর্ভস্থিত সমাধিগুলিতে (catacombs) আত্মগোপন করিবার জন্য আশ্রয় লইয়াছিল। এই উদ্দেশ্যে তাহারা ক্যাটাকম্বগুলিকে বিস্বয়করভাবে উপযোগী করিয়া লইয়াছিল, বিভিন্ন মুখী রাস্তার গোলকধাঁধা সৃষ্টি করিয়াছিল এবং নানা স্থানে অসংখ্য ছোট ছোট কুঠরী ও লুকাইয়া থাকার স্থান তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছিল যাহাতে অন্ধকারে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা তাহাদের অবস্থান ঠাহর করিতে না পারে। ক্যাটাকম্বগুলির সমাধি-শিলাতে উৎকীর্ণ শিরোনাম হইতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, প্রাথমিক খৃষ্টানগণ অবিচল একেশ্বরবাদী ছিল। শিলালিপিগুলিতে হযরত ঈসা (আঃ)-কে একজন মেষপালক অথবা আল্লাহ্র পয়গম্বররূপে এবং তাঁহার মাতা মরিয়মকে মাত্র একজন ধার্মিকা স্ত্রীলোকরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাও দৃষ্টি গোচর হয় যে, খৃষ্টানগণ, যাহারা ‘ক্যাটাকম্বে’ আশ্রয় নিয়াছিল তাহারা প্রবেশ পথের মুখে কুকুর রাখিত যেন উহারা আগন্তকের আগমন বার্তা চিৎকার করিয়া ঘোষণা করিতে পারে। এরূপে গুহার অধিবাসী সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক যুগের ধৃষ্টীনজাতির ইতিহাস তুলিয়া ধরে এবং প্রমাণ করে যে, তৌহীদে বিশ্বাসের কারণে তাহারা কিরূপ অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন ভোগ করিয়াছিল। ১৮ আয়াতে উল্লিখিত গিরি-গুহার অবস্থান ও বিবরণ গুরুত্বের দিক দিয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের। ইহা অন্যান্য স্থানের গিরিগুহার তুলনায় রোমের ক্যাটাকম্বসমূহ সম্বন্ধে পূর্ণভাবে, বিস্তারিতভাবে এবং যথাযথ ও নির্ভুলভাবে প্রযোজ্য। গুহাবাসীগণের ঘটনা অ্যারিম্যথিয়া যোসেফ্ এবং তাহার সঙ্গীগণ সম্পর্কেও প্রয়োগ করা যাইতে পারে। মালমেসবারির উইলিয়ামের মতে সেন্ট ফিলিপ কর্তৃক যোসেফ বৃটেনে প্রেরিত হইয়াছিলেন এবং সমারসেট শায়ারে ছোট একটি দ্বীপ তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল। সেখানে ক্ষুদ্র ডালপালা পাকাইয়া উহা দ্বারা তিনি বৃটেনের প্রথম খৃষ্টান গির্জা তৈয়ার করেন, যাহা পরবর্তী সময়ে গ্লাসটনবারী (Glastonbury) মঠরূপে পরিণত হয়। অন্য এক বিবরণ মতে, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ভ্রমণ করিয়া যোসেফ ৬৩ খৃষ্টাব্দে বৃটেনে পৌঁছেন। লোক-কাহিনী অনুযায়ী গ্লাসটনবারী (Glastonbury)-এর প্রথম গির্জা (ডালপালা দ্বারা তৈরী দেওয়াল ও ছাদের গৃহ) সেন্ট ফিলিপ কর্তৃক গাউল (Gaul) হইতে বৃটেনে প্রেরিত খৃষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের নেতা এরিম্যাথিয়া (Arimathaea) যোসেফ নির্মাণ করিয়াছিলেন (এনসাইক ব্রিট, ১০ম ও ১৩শ সংস্করণ, ‘যোসেফ অব এরিম্যাথিয়া’ এবং ‘গ্লাসটনবারী’ অধ্যায়ধীন)।সর্বশেষ মতে, যাহা ‘ডেড সী স্ক্রল’ বা মৃত সাগরে প্রাপ্ত—যেখানে প্রাথমিক যুগের খৃষ্টানগণ আশ্রয় নিয়াছিল এবং যেখানে তাহারা নিজেদেরকে ধমবিশ্বাস ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিল—উহা মৃত সাগরের নিকটবর্তী উপত্যকার গুহাগুলিকে নির্দিষ্ট করে। ‘গুহা’ এবং ‘শিলালিপি’ খৃষ্টীয় বিশ্বাসের দুইটি বিশিষ্ট প্রতিরূপ প্রকাশ করে, অর্থাৎ আত্মত্যাগ এবং পার্থিব জগত প্রত্যাহারকে ধর্মরূপে গ্রহণ করার পর হইতে খৃষ্টধর্ম যাত্রা শুরু করিয়াছিল এবং পরিণামে সমাপ্তি টানিয়াছে পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ধর্মরূপে। (দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারীও দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা ১৪৮৬-১৪৯০)।