১৫৯০

এই আয়াতে হযরত রসূল করীম (সাঃ)-এর এক কাশফ (দিব্য-দর্শন)-এর কথা ব্যক্ত হইয়াছে যাহা অধিকাংশ তফসীরকারকগণের মতে মে’রাজ (আধ্যাত্মিক স্বর্গারোহণ) বলিয়া পরিচিত। সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণার বিপরীতে আমাদের মতে এই আয়াতে নবী করীম (সাঃ)-এর ইস্‌রা (রাত্রিকালীন আধ্যাত্মিক সফর) সম্বন্ধে ব্যক্ত হইয়াছে, যাহাতে আঁ-হুযুর (সাঃ) কাশ্‌ফ যোগে মক্কা হইতে জেরুযালেম পর্যন্ত সফর করিয়াছেন। মে’রাজ সম্পর্কে সূরা আন নজমে মোটামুটিভাবে বর্ণিত হইয়াছে। সূরা আন নজমে উল্লেখিত ঘটনাসমূহ (আয়াত ৮-১৮), যাহা নবুওয়াতের পঞ্চম বৎসরে রজব মাসে কিছু সংখ্যক সাহাবার (রাঃ) আবিসিনিয়াতে হিজরতের পরে পরেই নাযেল হইয়াছিল। হাদীস শরীফে রসূলে করীম (সাঃ)-এর মে’রাজ সম্পর্কিত ঘটনাবলী সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে। এই আয়াতে মক্কা হইতে জেরুযালেম পর্যন্ত নবী করীম (সাঃ)-এর ইস্‌রা (রাত্রিতে আধ্যাত্মিক ভ্রমণ) সম্বন্ধে আলোচিত হইয়াছে। যুরকানীর মতে উহা নবুওয়াতের একাদশ বৎসরে সংঘটিত হইয়াছিল, এবং মূর্হর ও কোন কোন খৃষ্টান লেখকের মতে নবুওয়াতের দ্বাদশ বৎসরে ঘটিয়াছিল। যাহা হউক ইবনে সা’আদ এবং মারদাওয়াইয়ের মতে হিজরতের ১ বৎসর পূর্বে রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখে এই ইস্‌রার ঘটনা ঘটিয়াছিল (আল-খাসাইসুল কুবরা)। বায়হাকীও বর্ণনা করিয়াছেন যে, হিজরতের এক বৎসর বা ছয়মাস পূর্বে ইস্‌রা সংঘটিত হইয়াছিল। এইরূপে সকল সংশ্লিষ্ট বর্ণনা হইতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, নবুওয়াতের দ্বাদশ বৎসরে হিজরতের এক বৎসর বা ছয় মাস পূর্বে ইস্‌রার ঘটনা ঘটিয়াছিল। সেই সময়ে দশম বৎসরে হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর হযরত রসূলে করীম (সাঃ) তাঁহার চাচাত বোন উম্মে হানীর সঙ্গে বসবাস করিতেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিতগণের মতে মে’রাজ সংঘটিত হইয়াছিল নবুওয়াতের পঞ্চম বৎসরে। অতএব ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ের মধ্যেও ৬/৭ বৎসরের ব্যবধান রহিয়াছে। কাজেই এই ঘটনা দুইটি ভিন্ন ভিন্ন, একটি অন্যটি হইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ইহা ছাড়া ঐ সকল ঘটনা যাহা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মে’রাজের ঘটনা বলিয়া হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে তাহা ইস্‌রার ঘটনাবলী হইতে সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের। ঘটনাদ্বয় আধ্যাত্মিক বিস্বয়কর ব্যাপার ! হযরত নবী করীম (সাঃ) সশরীরে উদ্ধাগমন করেন নাই বা জেরুযালেমে গমন করেন নাই। ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়াও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট রক্তান্তসমূহও এই মতেরই সমর্থন করে যে, এই দুইটি ঘটনা একটি অন্যটি হইতে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। (ক) পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা আন নজমে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মে’রাজ সম্বন্ধে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু ইস্‌রা সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নাই। অথচ আলোচ্য আয়াতে তাঁহার ইস্‌রার কথা বর্ণনা করা হইয়াছে কিন্তু মে’রাজ সম্পর্কে কোন পরোক্ষ আয়াত পর্যন্ত নাই। (খ) ইস্‌রা সংঘটিত হওয়ার রাত্রে রসূলে করীম (সাঃ) তাঁহার চাচাতো বোন উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন এবং তিনি শুধু তাঁহার জেরুযালেম সফরের কথাই বলিয়াছেন, জান্নাত সফরের কোন কথাই বলেন নাই। তিনিই (উম্মে হানী) প্রথম মহিলা যাহার নিকট আঁ-হযরত (সাঃ) তাঁহার জেরুযালেমে রজনীযোগে আধ্যাত্মিক ভ্রমণের কথা প্রকাশ করেন এবং অন্ততঃপক্ষে সাত জন মোহাদ্দিস (হাদীস সংগ্রহকারী) উম্মে হানীর নাম উল্লেখের সহিত চারজন ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়াতকারীর বরাত দিয়াছেন যাহারা উম্মে হানীর নিকট হইতে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন। এই চার জন বর্ণনাকারী একই রেওয়ায়াত করিয়াছেন যে, নবী করীম (সাঃ) যে রাত্রে জেরুযালেম ভ্রমণ করিয়াছিলেন, সেই রাত্রেই তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। যদি আঁ-হযরত (সাঃ) তাঁহার বেহেশতে আরোহণের কথা বলিতেন তাহা হইলে উম্মে হানী তাঁহার একাধিক বর্ণনার কোন একটিতে অন্ততঃ এই বিষয়ে উল্লেখ না করিয়া পারিতেন না। কিন্তু তিনি তাঁহার কোন রেওয়ায়াতেই একথা উল্লেখ না করায় ইহা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, যে রাত্রিতে নবী করীম (সাঃ) কেবল ইস্‌রা বা জেরুযালেমে আধ্যাত্মিক সফর করিয়াছিলেন, সেই রাত্রিতে মে’রাজ সংঘটিত হয় নাই। মনে হয় কতক বর্ণনাকারী ইস্‌রা ও মে’রাজ—এই দুইটি বিষয়কে এক করিয়া ফেলিয়াছেন। এই গরমিল সম্ভবতঃ ‘ইস্‌রা’ শব্দ হইতে সৃষ্টি হইয়াছে, কারণ ইহা ‘ইস্‌রা’ এবং মে’রাজ উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে এবং ইস্‌রা ও মে’রাজের বিবরণের কোথাও কোথাও সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকায় এই বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পায় এবং বদ্ধমূল হইয়া যায়। (গ) যে সব হাদীস প্রথমে আঁ-হযরত (সাঃ)-এর জেরুযালেম সফর এবং তৎপর সেখান হইতে ঊর্ধ্বলোকে তাহার পরিভ্রমণের বিবরণ দিয়াছে, সেগুলিতে উল্লেখ রহিয়াছে যে, মহানবী (সাঃ) জেরুযালেমে পূর্ববর্তী নবীগণের সঙ্গে সাক্ষাত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন হযরত আদম, ইব্‌রাহীম, মূসা ও ঈসা (আঃ) এবং বেহেশতেও পুনরায় তাঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাত হইয়াছিল, কিন্তু সেখানে তিনি তাঁহাদিগকে চিনিতে পারেন নাই। এখন প্রশ্ন জাগে যে, এই নবীগণ (আঃ) যাঁহাদের সঙ্গে মহানবী (সাঃ)-এর জেরুযালেমে দেখা হইয়াছিল, সেখান হইতে তাহারা কিরূপে তাহার পূর্বেই বেহেশতে পৌঁছিয়া গেলেন, এবং একই সফরের মধ্যে কিছুক্ষণ পূর্বে যাহাদিগকে দেখিয়াছিলেন তাহাদিগকে তিনি কেনইবা চিনিতে পারিলেন না? ইহা কল্পনা করা যায় না যে, উল্লেখিত সফরের মধ্যে মাত্র আঁ-হযরত (সাঃ) অল্পক্ষণ পূর্বেই যাহাদিগকে দেখিয়াছিলেন ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানেই তিনি তাহাদিগকে চিনিতে ব্যর্থ হইলেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন “দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী”- পৃঃ ১৮০৮—১৮০৯।