‘সালসাল’ অর্থাৎ ‘খনখনে শুষ্ক কাদা’ এই কথা ইঙ্গিত করে যে, তাহাকে এমন এক জড়বস্তু হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে যাহার মধ্যে বাকশক্তির গুণাবলী গুপ্ত ও সুপ্ত রহিয়াছে। ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, ঐশী আওয়াজে সাড়া দেওয়া বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষমতাসম্পন্ন গুণাবলী দ্বারা মানুষকে বিভূষিত করা হইয়াছে। কিন্তু ‘সালসাল’কে বাহিরের কোন বস্তু দ্বারা কেবল আঘাত করিলেই যেমন শব্দ নির্গত হয়, সেইরূপ এখানে ‘সালসাল’ শব্দ দ্বারা ইহাই ইঙ্গিত করিতেছে যে, মানুষের প্রতিধ্বনি করার শক্তি ঐশী ডাক বা বাণীর অধীন বা উহার উপর নির্ভরশীল। এই গুণ বা ধীশক্তিই সমস্ত সৃষ্ট জগতের উপর মানবের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। ‘হামা’ (কালো পচা কাদা) শব্দটি ইহাই ব্যক্ত করিতেছে যে, মানুষকে সৃষ্টি করা হইয়াছে কালো কাদা মাটি হইতে; মাটি দেহের অধিকরণ এবং পানি আত্মার উৎস। অন্যত্র কুরআন করীম স্বতন্ত্রভাবে ‘মাটি’ এবং ‘পানি’ হইতে মানুষ সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে (৩ঃ৬০, ২১ঃ৩১)। ‘সালসাল’ শব্দ ‘হামা’ শব্দের সংগে যুক্ত করিয়া কুরআন করীম এই মর্মের প্রতি ইঙ্গিত করিতেছে যে, যে স্থলে অন্যান্য সজীব প্রাণীর সৃষ্টি শুধু হামা অর্থাৎ মাটি ও পানি হইতে, কারণ ইহাদের ও (প্রাণীকুল) এক প্রকার অপরিণত আত্মা রহিয়াছে, সেখানে হামা এবং সালসাল সংযুক্ত হইয়া বাক্শক্তি গুণসম্পন্ন মানুষের সৃষ্টি হইয়াছে। তাহাকে ‘মাসনূন’ও (যাহার উপর বহুকাল অতীত হওয়ার ফলে আকৃতি-প্রকৃতি পরিবর্তীত হইয়াছে বলা হইয়াছে(৯৫ঃ৫)। এই আয়াত দ্বারা ইহা বুঝায় না যে, পচা কাদা-মাটির বস্তুতে আল্লাহ্তা’লা জীবন ফুকিয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উহা ছাঁচে ঢালা জীবন্ত মানুষে পরিণত হইয়াছে। কুরআন বার বার ঘোষণা করিয়াছে যে, ক্রম-বির্বতনের মধ্য দিয়া এই বিশ্বজগতের সৃষ্টি। বর্তমান আয়াত মানব সৃষ্টির কেবল প্রাথমিক স্তর সম্বন্ধে ব্যক্ত করিয়াছে। অন্যান্য স্তর সম্পর্ক ৩০ঃ২১; ৩৫ঃ১২, ২২ঃ৬, ২৩ঃ১৫ এবং ৪০ঃ৬৮ আয়াতসমূহে উল্লেখ রহিয়াছে। কুরআনের বর্ণনানুযায়ী মানুষকে “মাটি” হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে ইহার মর্ম দাঁড়ায় যে, মানব সৃষ্টির দীর্ঘ প্রক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছিল ‘মাটি’ হইতে। ইহার সমর্থন বাস্তব ঘটনা হইতে পাওয়া যায়, যথাঃ আজও মানুষের খাদ্য মাটি হইতে পাওয়া যায়, ইহার কতক প্রত্যক্ষভাবে এবং কতক পরোক্ষভাবে মাটি হইতেই প্রাপ্ত। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, মাটিতে ধারণ-করা জড় পদার্থই হইল মানব-জন্মের উপকরণ; উহা যদি না হইত তবে সে ইহা (মৃত্তিকা) হইতে পুষ্টি আহরণ করিতে পারিত না। কারণ একমাত্র সেই বস্তুই যাহা হইতে কোন সত্তা বা জীবের উৎপত্তি, তাহা সেই উৎপন্ন সত্তার পুষ্টি সরবরাহ করিতে পারে—ভিন্ন বা অপরিচিত উপাদান উহার ক্ষয় পূরণ করিতে অক্ষম। (এই আয়াতের আরও ব্যাখ্যার জন্য ‘দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী’ দ্রষ্টব্য)