৫৬১

‘মা মালাকাত্‌ আইমানুকুম’ (তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারভুক্তগণ) শব্দ সমষ্টির তাৎপর্য হইলঃ ঐ সব স্ত্রীলোক যাহারা শত্রুদের পক্ষে ইসলাম-বিধ্বংসী যুদ্ধে যোগ দান করিয়া মুসলমানের হাতে ধৃত ও যুদ্ধবন্দী হইয়াছে, যাহাদিগকে স্বপক্ষীয়রা মুক্তি-পণ দানের মাধ্যমে বা অন্যভাবে মুক্ত করিয়া নেয় নাই এবং যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে যাহারা ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে নিজেদেরকে বঞ্চিত করিয়াছে। এই শব্দসমষ্টি (তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারভুক্তগণ), ‘ইবা দ’ (কৃতদাসী) বা ‘ইমা’ (বাঁদী) শব্দগুলির পরিবর্তে এই জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে, যাহাতে ইহাদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত প্রতিপন্ন হয়। ‘মিল্‌ক ইয়ামীন’ (দক্ষিণ হস্তের অধিকার)-এর তাৎপর্য ন্যায়ানুগ ও পূর্ণ অধিকার (লিসান)। ইহাদ্বারা কৃতদাস ও কৃতদাসী উভয়কেই বুঝায়, পূর্বাপর সম্পর্ক দ্বারা নির্দিষ্ট স্থানে কৃতদাস না কৃতদাসী বুঝাইয়াছে, তাহা জানা যায়। “তাহাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারভুক্ত” বলিতে সঠিক কি বুঝায়, ইহা নিয়া বহু বিতর্ক রহিয়াছে এবং ভুল বুঝাবুঝি আছে। ইহাদের উপর অধিকারী ব্যক্তিরই বা কিরূপ ও কি পরিমাণ অধিকার আছে, তাহা নিয়াও মতভেদ আছে। তবে ইসলাম কৃতদাস প্রথাকে সর্বতোভাবে ও দৃঢ়তার সহিত মূলোৎপাটন করিয়াছে। ইসলামের মতে, কোন মানুষকে তাহার ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত করা এক মারাত্মক পাপ বিশেষ। তবে ইসলামের বিরুদ্ধে বা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধ্বংসকারী যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া যাহারা নিজেদেরকে সেই ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত করে, তাহাদের কথা স্বতন্ত্র। কৃতদাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ও ইসলামে মহা পাপ। এই ব্যাপারে ইসলামী শিক্ষা দ্ব্যর্থহীন, পরিষ্কার ও সুদৃঢ়। এই শিক্ষানুযায়ী, যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের কৃতদাসে পরিণত করে, সে আল্লাহ্ ও মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর পাপ করিয়া থাকে (বুখারী, কিতাবুল বায়য়ে এবং ফতহুল বারি উদ্ধৃত-দাউদ)। এখানে এই কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যখন জগতে ইসলামের আবির্ভাব হইয়াছিল, তখন পৃথিবীর সকল দেশেই কৃতদাস প্রথা মানব সমাজের একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। প্রত্যেক দেশেই বিরাট সংখ্যক কৃতদাস ছিল। অতএব, গভীর শিকড়ের উপর দণ্ডায়মান সমাজ কাঠামোতে প্রোথিত বহুদিনের একটি সমাজ-প্রথাকে এক কলমের খোঁচায় বা একটি আদেশের বলে এক মুহূর্তে তুলিয়া দেওয়া না ছিল সম্ভবপর, না হইত বিজ্ঞজনোচিত কাজ। সমাজকে রক্ষা করিয়া, নূতন নীতি ও বিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কার সাধন করাই ছিল এই চিরাচরিত প্রথার অবসানের সঠিক পথ। তাই ইসলাম ধীরে ধীরে কার্যকরী পন্থায়, নিশ্চিতভাবে ইহার অবসানের লক্ষ্যে আগাইয়া চলিয়াছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃতদাস প্রথা বিলোপের জন্য কুরআন-প্রদত্ত অভ্রান্ত ও কার্যকরী নিয়ম-নীতি হইলঃ (১) কেবল মাত্র নিয়মিতভাবে ঘোষিত যুদ্ধের ফলেই, যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীকে বন্দী করা যাইতে পারে, (২) যুদ্ধ শেষ হইয়া গেলে যুদ্ধ বন্দীকে আবদ্ধ রাখা যাইবে না, বরং (৩) হয়তো পরস্পর যুদ্ধ-বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে অথবা দয়া-দাক্ষিণ্যের চিহ্ন রূপে যুদ্ধ-বন্দীকে মুক্তি দিতে হইবে (৪৭ঃ৫)। যে সকল হতভাগ্য বন্দী উপরোক্ত তিনটি উপায়ের মাধ্যমেও মুক্তি না পায়, কিংবা যাহারা তাহাদের মুসলমান মনিবকে ছাড়িয়া যাইতে না চায় তাহারা স্বীয় মনিবের সাথে এক ধরণের চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের মুক্তি অর্জন করিতে পারিবে, যাহাকে বলা হয় ‘মুকাতাবাহ্‌’ চুক্তি (২৪ঃ৩৪)। এখন, এই ধরণের নিয়মিত যুদ্ধের ফলে যদি কোনও স্ত্রীলোক বন্দী হইয়া ‘মিল্‌ক ইয়ামীন’এ পরিণত হয়, অতঃপর বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে যদি সে মুক্তি লাভ করিতে না পারে, বিজয়ী সরকার যদি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাহাকে অনুগ্রহজনিত মুক্তিদানের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা বিপজ্জনক মনে করে এবং তাহার স্বজাতি যদি তাহাকে মুক্তি-পণের মাধ্যমে মুক্ত করিয়া না নেয়, এমন কি সে যদি নিজেও ‘মুকাতাবাহ্‌’র সুযোগ গ্রহণ না করে, আর এই অবস্থায় যদি তাহার অধিকারী, তাহার সম্মতি না নিয়াই নিজের নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার জন্য তাহাকে সর্ব সমক্ষে বিবাহ করে, তাহা হইলে এই ব্যবস্থাকে আপত্তিজনক মনে করার কি আছে? যুদ্ধ-বন্দিনী কিংবা কৃতদাসীর সহিত বিবাহ ছাড়া কোনরূপ যৌন সম্পর্ক স্থাপন কুরআনের এই আয়াত বা অন্য কোন আয়াত দ্বারাই সমর্থিত হয় না। বিবাহ ব্যতীত, সর্ব প্রকার যৌন সম্পর্ক ইসলামে মহা পাপ। তাই কুরআনে যুদ্ধ-বন্দিনীকে বিবাহ না করা পর্যন্ত তাহার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি তো দেয় নাই, বরং কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে যে, এই বন্দিনীগণকে স্ত্রীরূপে রাখার পূর্বে স্বাধীন নারীদের মতই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইবে। স্বাধীনা রমণী ও যুদ্ধ-বন্দিনী (মিল্‌ক ইয়ামীন)- আর মধ্যে পার্থক্য মাত্র এইটুকু যে, স্বাধীনার নিজ সম্মতি ব্যতীত বিবাহ হইতে পারে না, আর যুদ্ধ বন্দিনী ইসলামকে ধ্বংস করার যুদ্ধে অংশ গ্রহণের কারণে, তাহার পূর্ব সম্মতি দানের সুযোগ হইতেসে নিজেকে বঞ্চিত করিয়াছে। অতএব,’মা মালাকাত আইমানুকম’ শব্দগুলির মধ্যে কোথাও এই ধারণা সৃষ্টির অবকাশ নাই যে, কুরআন বা ইসলাম উপ-পত্নী রাখা অনুমোদন করে। অত্র আয়াত ছাড়া, অন্ততঃ আরও চারটি আয়াতে এই কথাই আদেশ স্বরূপ আসিয়াছে যে, যুদ্ধ-বন্দিনীগণের কাহাকেও অবিবাহিতাভাবে রাখা উচিত নয় (২ঃ২২২, ৪ঃ৪; ৪ঃ২৬, ২৪ঃ৩৩)। নবী করীম (সাঃ) স্বয়ং এই ব্যাপারে স্পষ্ট অভিমত দান করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, “যাহার ঘরে কৃতদাসী বালিকা আছে, সে যদি তাহাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া প্রতিপালন করিয়া বড় করে, এবং তাহাকে মুক্তি দিয়া বিবাহ দেয়, সে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত হইবে” (বুখারী, কিতাবুল ইল্‌ম্‌)। নবী করীম (সাঃ)-এর বাক্যটিতে এই কথাই বলা হইয়াছে যে, যদি কোন মুসলমান স্বীয় কৃতদাসীকে বিবাহ করিতে চায়, তাহা হইলে প্রথমে তাহাকে দাসত্বমুক্ত করিবে, তারপর বিবাহ করিবে। তাঁহার এই উপদেশ তিনি স্বয়ং (সাঃ) নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করিয়া দৃষ্টান্তও স্থাপন করিয়াছেন। হুযুর (সাঃ)-এর দুই পত্নী জোয়াইরিয়া ও সাফিয়া যুদ্ধ-বন্দিনীরূপেই তাঁহার (সাঃ) হাতে আসিলেন। তাঁহারা ছিলেন তাঁহার ‘মিল্‌ক ইয়ামীন’। তিনি তাহাদিগকে পূর্ণ ইসলামী নিয়মানুযায়ী বিবাহ করিলেন। মিশরের বাদশাহ উপঢৌকন স্বরূপ নবী করীম (সাঃ)কে বহু কিছু পাঠাইলেন, এর মধ্যে ‘মারীয়া’ নাম্নী একজন কৃতদাসীও পাঠাইলেন। তিনি তাহাকে বিবাহ করিয়া অন্যান্য স্বাধীনা স্ত্রীগণের মধ্যে তাহাকেও অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইলেন। মারীয়াও অন্যান্য স্ত্রীদের মত পর্দা পালন করিতেন। তাঁহাকে ‘উম্মুল মো’মেনীন’এর মর্যাদায় উন্নীত করিয়া নবী করীম (সাঃ) অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। কুরআন স্পষ্ট করিয়া বলিতেছে যে, বিবাহ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী ‘যাহা তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারভুক্ত’ তাহাদের উপরেও সমভাবে প্রযোজ্য, যেরূপ ভাবে ঐনির্দেশাবলী নবী করীম (সাঃ)-এর ফুফাত, খালাত, মামাত ও চাচাত বোনদের উপর প্রযোজ্য। স্ত্রীর মত ব্যবহারের পূর্বে উপরোক্ত সকল শ্রেণীর স্ত্রীলোককেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিতে হইবে। রসূলে পাক (সাঃ) স্বয়ং উপরোক্ত সকল শ্রেণীর স্ত্রীলোককে বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রী বানাইয়া তাহাদেরকে স্ত্রীরূপে সঙ্গিনী করিয়াছেন (৩৩ঃ৫১)। তদুপরি, “মহিলাগণের মধ্য হইতে সকল মহিলাগণ (তোমাদের উপর হারাম করা হইল) তাহারা ব্যতীত যাহারা তোমাদের দক্ষিণ হস্তের অধিকারভুক্ত” (৪ঃ২৫) বাক্যটি এবং পূর্ববর্তী আয়াত (৪ঃ২৪), ঐ সব স্ত্রীলোকের কথা বলিয়াছে, যাহাদিগকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ শ্রেণীর মধ্যে রহিয়াছে বিবাহিতা মহিলারা। কিন্তু এই বিবাহিতা শ্রেণী হইতে যুদ্ধ বন্দী মহিলাদিগকে বাদ দেওয়া হইয়াছে। কেননা, এই যুদ্ধবন্দী মহিলারা ইসলামবিরোধী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিয়া মুসলমানের হাতে বন্দী হয় এবং তাহাদের স্বজাতিরা তাহাদের মুক্তির ব্যবস্থা না করার কারণে তাহারা নিজ নিজ মুসলমান মনিবের অধীনে থাকিয়া যাইতে চাহে। অতএব, তাহাদিগকে দাসী রূপে না রাখিয়া বিবাহ করিয়া রাখাই নৈতিকতার দিক দিয়া অধিকতর শ্রেয়ঃ। তাহাদের পূর্ব স্বামীর কাছে যাইতে না চাওয়া এবং পূর্ব স্বামী তাহাদিগকে মুক্ত করিয়া না নেওয়া বস্তুতঃ পূর্ব বিবাহ ভঙ্গ হইয়া যাওয়ার শামিল। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, যুদ্ধ-বন্দিনী (দাসী) স্ত্রীগণের ঐ সব আত্মীয়ার সাথে বিবাহও সমভাবে নিষিদ্ধ যেভাবে স্বাধীনা স্ত্রীর আত্মীয়াদের কাহারও কাহারও সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ দাসী স্ত্রীর মাতা, ভগ্নী, কন্যা ইত্যাদির সহিত বিবাহ নিষেধ। এখানে আরও বলা প্রয়োজন যে, কুরআন নাযেলের সময়কার অবস্থাদি বিবেচনা করিয়া এই দুই শ্রেণীর স্ত্রীলোকের সামাজিক মর্যাদার কিছুটা তারতম্য নির্ণীত হইয়াছিল। তারতম্য এতটুকুই ছিল যে, স্বাধীনা স্ত্রীকে বলা হইত ‘যাউজ’ এবং যুদ্ধবন্দিনী স্ত্রীকে বলা হইত ‘মিল্‌ক ইয়ামীন’। ‘যাউজ’ দ্বারা স্বামীর সমমর্যাদার অধিকারিণী বুঝাইত। আর ‘মিল্‌ক ইয়ামীন’ দ্বারা স্বামীর চাইতে কিছুটা খাটো মর্যাদার স্ত্রী বুঝাইত। তবে, তাহা ছিল একটা অপসৃয়মান দৃশ্য মাত্র। কুরআন এবং নবী করীম (সাঃ) এই চিন্তা ধারার বিপরীতে, অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলিয়াছিলেন যে, যুদ্ধ-বন্দিনী দাসীকে প্রথমে মুক্ত ও স্বাধীন করার পর, তাহার স্বাধীনতা কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত করার পর, বিবাহ করা উচিত, যেরূপ করিয়াছিলেন তিনি (সাঃ) নিজে। তাছাড়া ইসলাম একমাত্র নিয়মিত ধর্ম যুদ্ধের বন্দী স্ত্রীলোক ছাড়া, অন্য কোনও প্রকারের যুদ্ধ-বন্দিনীকে কৃতদাসী করার অনুমতি দেয় নাই। বন্দিনী দাসীকে তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বিবাহ করার অনুমতি দানের তখনই প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল, যখন শত্রুজাতি ইসলামকে ধরাধাম হইতে নিশ্চিহ্ন করিবার জন্য এবং তরবারীর জোরে মুসলমানদিগকে ধর্মান্তরিত করিবার উদ্দেশ্যে এবং ধূত ও বন্দী মুসলমানদিগকে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে, কৃতদাস-দাসী বানাইবার সংকল্প নিয়া অন্যায় ধর্মযুদ্ধ মুসলমানদের উপর চাপাইয়া দিয়াছিল। ইসলামের এই নির্দেশটি ছিল প্রতিকার ও প্রতিশোধ প্রণোদিত এবং সেই কারণে নিতান্তই অস্থায়ী ও আপেক্ষিক। তবে এই ব্যবস্থা দ্বারা বন্দিনী দাসীদের নৈতিকতাকেও নিরাপদ করা হইয়াছে, সন্দেহ নাই। ঐসব অবস্থাবলী আজিকার বিশ্বে নাই, আজ বিশ্বের কোথাও নিছক ধর্ম নিয়া যুদ্ধ বাধে না। তাই, যুদ্ধ বন্দীদিগকে দাস-দাসী বানাইবার প্রয়োজনও নাই।