৪২০-ঘ

বাইবেলে কোথাও উল্লেখ নাই যে, ঈসা (আঃ) মু’জেযা প্রদর্শন করিবার জন্য পাখি সৃষ্টি করিয়া আকাশে উড়াইয়াছিলেন। সত্যি সত্যি যদি ঈসা (আঃ) পাখি বানাইয়া উড়াইয়া থাকিতেন, তাহা হইলে বাইবেল তাহা উল্লেখ না করিয়া, কিভাবে ও কেন চুপ করিয়া থাকিল? আল্লাহ্‌র কোন নবী পূর্বে এই ধরণের ঐশী-নিদর্শন দেখান নাই, অথচ বাইবেল এই সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব রহিল, ইহা আশ্চর্য নয় কি? বাইবেলে এই মহা-নিদর্শনের উল্লেখ থাকিলে, সকল নবীর উপর ঈসা (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হইত এবং পরবর্তী কালের খৃষ্টানেরা ঈসার প্রতি যে ঈশ্বরত্ব আরোপ করিয়াছে, তাহাও কিছুটা সমর্থন লাভ করিত। ‘খাল্‌ক’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় (১) মাপ বা ওজন করা, পরিমাণ ঠিক করা, নক্সা তৈরী করা, (২) আকৃতি দেওয়া, তৈরী করা, সৃষ্টি করা ইত্যাদি অর্থ রহিয়াছে। এখানে প্রথমোক্ত অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। সৃষ্টি করা অর্থে ’খাল্‌ক’ শব্দটি কুরআনের কোথায়ও আল্লাহ্‌র কাজ ছাড়া অন্য কাহারও কাজ বলিয়া স্বীকৃতি পায় নাই, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাহারও প্রতি এই গুণটি, কুরআনের কোথায়ও আরোপিত হয় নাই (১৩ঃ১৭, ১৬ঃ২১, ২২ঃ৭৪; ২৫ঃ৪, ৩১ঃ১১-১২, ৩৫ঃ৪১ এবং ৪৬ঃ৫)। উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে এবং কাদামাটির রূপক অর্থ সম্মুখে রাখিয়া, “তোমাদের জন্য কাদা হইতে আমি পাখীর অবস্থার অনুরূপ সৃষ্টি করিব,অতঃপর উহার মধ্যে আমি (নবজীবন) ফুৎকার করিব, ফলে উহা আল্লাহ্‌র আদেশে উড্ডয়নশীল হইয়া যাইবে” ইত্যাদি কথার মর্ম বুঝিবার চেষ্টা করিলে, উহার তাৎপর্য দাঁড়াইবে এই যে, সাধারণ শ্রেণীর লোক – যাহাদের মধ্যে উন্নতি ও জাগরণের শক্তি রহিয়াছে, তাহারা যদি ঈসা (আঃ)-এর সংস্পর্শে আসে ও তাহার বাণী গ্রহণ করিয়া জীবন যাপন করে, তাহা হইলে তাহাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসিয়া যাইবে। ধূলি-ধূসরিত, সংসারাসক্ত, বস্তুকেন্দ্রিক জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়া, তাহারা আধ্যাত্মিক আকাশের উচ্চ মার্গে পাখীর মত বিচরণ করিতে সমর্থ হইবে এবং বস্তুতঃ, তাহাই ঘটিয়াছিল। ঘৃণিত, অবহেলিত গেলিলীর জেলেরা, তাহাদের প্রভু ও গুরুর উপদেশ ও উদাহরণ অনুসরণের মাধ্যমে, পাখীরই মত উচ্চমার্গে আরোহণ করিয়া, বনীইসরাঈল জাতির মধ্যে আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারের তৌফিক লাভ করিয়াছিল। অন্ধ ও কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তদের রোগমুক্তির বা উপশম দানের সম্বন্ধে বলা যায় যে, এই ধরণের রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদিগকে বনী ইস্‌রাঈল জাতি অপবিত্র ও নোংরা জ্ঞানে, সমাজের সংশ্রব হইতে দূরে রাখিত, সমাজে ঘেষিতে দিত না। ‘আমি নিরাময় করিব’ কথাটির তাৎপর্য ইহাই যে, এই সব রোগাক্রান্ত লোকেরা আইনগত ও সমাজগত ভাবে, অবহেলিত অবস্থায় বহু বঞ্চনা ও অসুবিধার মধ্যে ঘৃণার পরিবেশে বাস করিত। ঈসা (আঃ) আসিয়া তাহাদিগকে সেবা যত্ন করার তাগিদ দিয়া, সমাজে তাহাদিগকে স্থান দান করিয়া, তাহাদিগকে দুর্বিসহ জীবন হইতে মুক্ত করিয়াছিলেন। ইহাও হইতে পারে যে, ঈসা (আঃ) এই সব রোগীকে সুস্থ করিতেন। আল্লাহ্‌র নবীগণ আধ্যাত্মিক চিকিৎসক বিশেষ। তাহারা আধ্যাত্মিক অন্ধগণকে চক্ষুদান করেন, বধিরকে শ্রবণশক্তি দান করেন, আধ্যাত্মিক মৃতদিগকে জীবন দান করেন (মথি- ১৩ঃ১৫)। এখানে ‘আকমাহ্‌’ (রাতকানা) অর্থ ঐ লোক যাহার বিশ্বাস থাকা সত্বেও দুর্বল মানসিকতার কারণে পরীক্ষার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারে না। সে দিনের আলোতে দেখে অর্থাৎ যতক্ষণ পরীক্ষার ঝামেলা থাকে না এবং বিশ্বাসের সূর্য মেঘ-দুর্যোগ হইতে মুক্ত অবস্থায় কিরণ দেয়, তখন সে ঠিকই দেখে। কিন্তু যখন দুর্যোগের রাত্রি নামিয়া আসে অর্থাৎ পরীক্ষা ও আত্মোৎসর্গের সময় উপস্থিত হয়, তখন সে আধ্যাত্মিক আলো হারাইয়া ফেলে এবং থামিয়া যায় (২ঃ২১)। তেমনি ভাবে, ‘আব্রাস’ (কুষ্ঠরোগী) শব্দটি আধ্যাত্মিক অর্থে রুগ্ন ও দুর্বল বিশ্বাসকে বুঝাইয়াছে, যাহার আবরণ স্থানে স্থানে সুস্থ আবার স্থানে স্থানে ক্ষতপূর্ণ। ‘আমি মৃতগণকে জীবনদান করিব’ বাক্যটির অর্থ ইহা নয় যে, ঈসা (আঃ) মৃত ব্যক্তিকে সত্যই জীবিত করিয়াছিলেন। যাহারা প্রকৃতই মরিয়া যায়, তাহারা পৃথিবীর বুকে কখনও পুনজ্জবিত হয় না। এইরূপ বিশ্বাস কুরআনের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত (২ঃ২৯, ২৩ঃ১০০-১০১, ২১ঃ৯৬, ৩৯ঃ৫৯-৬০ ৪০ঃ১২, ৪৫ঃ২৭)। আধ্যাত্মিক পরিভাষা মতে, নবীগণ তাহাদের অনুসারীদের জীবনে যে বৈপ্লবিক ও অসাধারণ মহা-পরিবর্তন আনয়ন করেন, তাহাকেই বলা হয় ‘মৃতকে জীবিত করা’।