৩০৭

‘তালুত’ বনী ইসরাঈল জাতির একজন বাদ্‌শা, যিনি দাউদ নবী (আঃ)-এর দুইশত বৎসর পূর্বে এবং মূসা (আঃ)-এর দুইশত বৎসর পরে রাজত্ব করিয়াছিলেন। কুরআনের তফসীরকারকগণের মধ্যে কেহ কেহ তালুতকে ‘সাউল’ বলিয়া ভ্রম করিয়াছেন। কিন্তু কুরআনের বর্ণনা ‘গিদিওনের’ সহিত বেশী মিল খায়, সাউলের সহিত ততটা মিলে না (বিচারকর্তৃগণের বিবরণ ৬-৮)। গিদিওন ১২৫০ খৃষ্টপূর্বে ছিলেন এবং বাইবেল তাহাকে সাহসী ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্ব বলিয়া অভিহিত করিয়াছে (বিচারক ৬ঃ১২) আর তালুত বলিতেও তাহাই বুঝায়। কয়েকজন খৃষ্টান লেখক বলিয়াছেন যে, এই পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনা, দুইটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুইশত বৎসরের ব্যবধানে ঘটিয়াছে, অতএব এই পরিচ্ছেদটিতে ঘটনা বর্ণনায় কুরআনের ঐতিহাসিক কাল নির্ণয়ে ভ্রম পরিলক্ষিত হয়। পরিচ্ছেদটি নিশ্চয়ই দুই ভিন্ন সময়ের ঘটনাই উল্লেখ করিয়াছে। কিন্তু ইহাতে সময়ের কোন অসঙ্গতি ঘটে নাই। কুরআনের বর্ণনার আসল উদ্দেশ্য হইল, ইহুদী জাতির ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের বিচ্ছিন্নতাকে ছাড়াইয়া তাহাদের মধ্যে ঐক্য কিভাবে সম্পন্ন হইল, তাহা বর্ণনা করা। ঐক্য সাধনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছিল গিদিওনের (অর্থাৎ তালুতের) সময়ে, দাউদ (আঃ)-এর দুইশত বৎসর পূর্বে, আর তাহা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় দাউদ (আঃ)-এর রাজত্ব কালে। “মূসা (আঃ)-এর পরে” কথাটি পূর্ববর্তী কাছাকাছি সময়ে ঘটিয়াছিল, যখন ইসরাঈলীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল, তাহাদের কোন বাদশা ছিল না এবং তাহাদের কোন সেনা বাহিনীও ছিল না। তাহাদের দলাদলি ও বিশৃংখলার কারণে, আল্লাহ্‌ শাস্তি স্বরূপ তাহাদিগকে মিদিয়ানদের হাতে সমর্পণ করিলেন। মিদিয়ানরা সাত বৎসর ধরিয়া তাহাদের উপর লুণ্ঠন-নির্যাতন চালাইল এবং তাহারা পর্বত গুহায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হইল (বিচারক ১ঃ৬)। এই অসহায় অবস্থায় তাহারা আল্লাহ্‌র কাছে ক্রন্দন করিতে লাগিল এবং তিনি তাহাদের মধ্যে এক নবীর আবির্ভাব ঘটাইলেন। গিদওনের কাছে আল্লাহ্‌র এক ফিরিশ্‌তা আসিয়া তাহাকে বাদশা নিযুক্ত করিয়া স্বর্গীয় সাহায্যের আশ্বাস-বাণী প্রদান করিল। তখন গিদিওন আল্লাহ্‌কে বলিলেন, হে আমার প্রভু, কীভাবে, কী দিয়া আমি বনী ইসরাঈলকে বাঁচাইব? তুমি তো জান, আমি মানাশের এক গরীব পরিবারের লোক এবং আমার পিতার সন্তানদের মধ্যে আমি নগণ্য (বিচারক ৬ঃ৫)। এই কথাগুলি, কুরআনের আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত তালুতের বর্ণনার সহিত হুবহু মিলিয়া যায়। গিদিওন ও তালুত যে একই ব্যক্তি তাহা আরও পরিষ্কার হইয়া যায়, যখন দেখা যায় যে, গিদিওনের সময় ও সাউলের সময় এক নহে, ইসরাঈলীগণকে পানি দ্বারা কষ্ট দিয়া পরীক্ষা করা হইয়াছিল। বাইবেলে প্রদত্ত এই পরীক্ষার বর্ণনা (বিচারক ৭ঃ৪-৭) কুরআনের বর্ণনার সহিত একেবারে মিলিয়া যায়। বিচারক ৭ঃ৪-৭ হইতে আমরা জানিতে পাই যে, এই পরীক্ষার পরে গিদিওনের সাথে মাত্র তিনশত লোক অবশিষ্ট ছিল। ইহা এক চিত্তাকর্ষক ও কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার যে মহানবী (সাঃ)-এর একজন সাহাবী বলিয়াছিলেন; বদরের যুদ্ধে আমরা সংখ্যায় ছিলাম তিনশত তেরজন এবং এই সংখ্যাটি তালুতকে অনুসরণকারীদের সংখ্যার সমান” (তিরমিযী বাবুস সিয়ার)।

ইহা হইতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে সাহায্য করে যে, তালুত গিদিওন ব্যতীত অন্য কেহ নয়। তালুতও গিদিওন যে একই ব্যক্তি তাহা গিদিওন শব্দটির অর্থ হইতেও প্রতিপন্ন হয়। এই শব্দটি যে হিব্রু ধাতু হইতে উৎপন্ন হইয়াছে তাহার অর্থ হইল কাটিয়া ফেলিয়া দেওয়া বা কাটিয়া ফেলা’ (যিউইস এনসাই)। অতএব, গিদিওন অর্থ দাঁড়ায় “যে ব্যক্তি তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাটিয়া ধরাশায়ী করে।” এবং বাইবেলে গিদিওনকে ‘মহাশক্তিধর সাহসী ব্যক্তিত্ব’ হিসাবে অভিহিত করা হইয়াছে। (বিচারক ৬ঃ১২)। (ইংরাজী তফসীরে কবীর দেখুন)।