৪৭

এই আয়াতে বিশ্বাসীদের পারলৌকিক পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। ইসলামের সমালোচকেরা এই বিবরণের প্রতি আপত্তির ঝড় তুলিয়াছেন। বেহেশ্‌ত সম্বন্ধে ইসলামের ধারণা ও শিক্ষা কি তাহা না জানা ও সঠিকভাবে না বুঝার কারণেই এইসব অসমীচীন সমালোচনার উদ্ভব হইয়াছে। কুরআন অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ঘোষণা করিতেছে যে, ঐগুলির (বেহেশ্‌তী পুরস্কারসমূহের) প্রকৃতি জানা বা কল্পনা করা মানব-মনের পক্ষে সম্ভব নহে (৩২ঃ১৮)। রসূলে পাক (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘কোনও চক্ষু ইহাদিগকে (বেহেশতী পুরস্কারসমূহকে) দেখে নাই, কোনও কর্ণ ইহাদের সঠিক বর্ণনা শুনে নাই, কোন মনও ইহাদের ধারণা করিতে পারে নাই’ (বুখারী)। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহা হইলে, ইহজগতের বস্তুর নামে বেহেশ্‌তের আশিসসমূহকে অভিহিত করার সার্থকতা কি? ইহার জবাব এই যে, কুরআন কেবলমাত্র উচ্চস্তরের বুদ্ধিদীপ্তদের জন্যই নহে বরং সর্বসাধারণের জন্যও। তাই এমন সরল-সহজ ভাষা ব্যবহার করা হইয়াছে, যাহা সকলেই বুঝে। বেহেশ্‌তের আশিসসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে, কুরআন ঐসকল পার্থিব জিনিষগুলিরই নাম ব্যবহার করিয়াছে যেগুলিকে মানুষ সাধারণতঃ ভাল বলিয়া জানে ও পসন্দ করে এবং বিশ্বাসীগণকে বলা হইয়াছে যে, এই সব ভাল জিনিষগুলি তাহারা আরও উৎকৃষ্টতর আকারে বেহেশ্‌তে প্রাপ্ত হইবে। এই আবশ্যকীয় তুলনামূলক চিত্র দিবার জন্যই, ভাল-ভাল জানা জিনিষের নাম ও সুপরিচিত শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে। নতুবা ইহজগতের সুখ ও আনন্দ এবং পরজগতের আশিসসমূহের মধ্যে কোন মিল নাই, ইহাদের উভয়ে মোটেই একজাতীয় বা এক ধরণের নহে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী পরকাল কেবলমাত্র একটা মানসিক বা আধ্যাত্মিক অবস্থার নাম নহে। পরকালেও মানবাত্মা এক প্রকারের দেহ প্রাপ্ত হইবে, তবে ঐ দেহ স্থূল বস্তু হইবে না। স্বপ্নে দৃষ্ট দৃশ্যাবলীর উদাহরণ হইতে বিষয়টা কতক পরিমাণে আঁচ করা যাইতে পারে। স্বপ্নে মানুষ যাহা দেখে, তাহা যে কেবলমাত্র মানসিক বা আধ্যাত্মিক, এ কথা বলা যায় না। কেননা, স্বপ্নাবস্থায়ও তাহার দেহ থাকে, সে নিজেকে স্রোতস্বিনী-বিধৌত মনোরম বাগানে ভ্রমণরত অবস্থায় দেখে এবং সেখানে ফলমূল ও দুগ্ধ পান করিতে দেখে। একথা বলা কঠিন যে, স্বপ্নের বিষয়বস্তু শুধু মানসিক অবস্থা বিশেষ। স্বপ্নে দুগ্ধ পানের তৃপ্তি নিঃসন্দেহে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা, তাহা সত্বেও কেহই বলিবে না যে, ইহা এই জগতে প্রাপ্ত দুধ যাহা সে পান করিয়াছে। আল্লাহ্‌তা’লার যে সকল দান আমরা ইহকালে উপভোগ করিয়া থাকি, পরকালের আশীর্বাদসমূহ সেইগুলিরই মনস্তাত্বিক রূপায়ণ বলা ঠিক হইবে না। বরং এই জগতে যাহা আমরা পাই তাহা আল্লাহ্‌তা’লার সত্যিকার খাঁটি দান ও আশীর্বাদসমূহের নমুনা স্বরূপ, আসলে সত্য-সত্য দান সমূহের প্রাপ্তিস্থান হইল পরকাল। অধিকন্তু বাগান সমূহ বলিতে বুঝায় বিশ্বাস এবং ‘স্রোতস্বিনী’ বলিতে বুঝায় কর্ম সমূহ। বাগান টিকিতে পারে না ও ফলফুল সুশোভিত হইতে পারে না যদি সেখানে স্রোতস্বিনী তথা পানির ব্যবস্থা না থাকে। তেমনি বিশ্বাস ফলপ্রসূ হইতে পারে না যদি সৎ কর্মের দ্বারা ইহাকে সুদৃঢ় করা না হয়। অতএব, বিশ্বাস ও সৎ কর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরিত্রাণের জন্য উভয়ের একত্রে সমাবেশ অত্যাবশ্যক।

পরকালে, বাগানগুলি বিশ্বাসীদিগকে তাহাদের ইহলৌকিক বিশ্বাসের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে এবং স্রোতস্বিনী গুলি তাহাদের ইহকালীন সৎকর্মসমূহকে স্মরণ করাইয়া দিবে। তাহারা তখন সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিতে পারিবে, তাহাদের বিশ্বাস ও সৎকর্ম বৃথা যায় নাই। ইহা আমাদিগকে পূর্বেও দেওয়া হইয়াছিল মো’মেনের এই উক্তি হইতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হইবে না যে, বেহেশ্‌তে তাহাদিগকে এইসব ফলই দেওয়া হইবে, যাহা তাহারা ইহকালে উপভোগ করিয়াছিল। কেননা, পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হইয়াছে যে, এই দুই বস্তু এক নয়। প্রকৃত পক্ষে পরকালের ফলগুলি হইবে তাহাদের ইহকালীন বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি যখন তাহারা সেইগুলি খাইবে, তখন তাহারা সাথে সাথেই উপলব্ধি করিবে যে, এইগুলি তাহাদের ইহকালীন জীবনের বিশ্বাসের ফল মাত্র। তাই, তাহারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আনন্দাতিশয্যে বলিয়া উঠিবে ‘ইহা আমাদিগকে পূর্বেও দেওয়া হইয়াছিল।’ এই শব্দগুলির অর্থ ইহা হইতে পারে, ইহা দেওয়া হইবে বলিয়া আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি করা হইয়াছিল। পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ বলিতে বুঝাইতেছে যে, ইহকালে অনুসৃত নীতি ও ধর্ম কর্ম এবং পরকালে প্রাপ্ত উহার প্রতিফল ও পুরস্কার, এই দুইয়ের মাঝে ঘনিষ্ঠ মিল থাকিবে। ইহকালের ইবাদত বা আরাধনা-উপাসনা পরকালে মো’মেনদের কাছে ফল-স্বরূপ উপস্থিত হইবে। একজন লোকের ইবাদতের মধ্যে যত বেশী সরলতা ও যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্য থাকিবে, সেই অনুপাতে বেহেশ্‌তে তাহার ফলভোগের আনন্দও তত বেশী হইবে। এমনকি ফলের গুণাগুণের মধ্যেও আনুপাতিক হারে তারতম্য হইবে। তাই পরলোকে অধিক হইতে অধিক গুণসম্পন্ন ফল প্রাপ্তির জন্য ইহলোকে অধিক হইতে অধিক ধর্ম-কর্ম করিতে হইবে, ইহা করা মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতার অধীন। এই আয়াতের আরেকটি তাৎপর্য এই যে, বেহেশ্‌তে যে আধ্যাত্মিক খাদ্য মানুষকে দেওয়া হইবে, তাহা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী, তাহার আত্মিক স্তর ও অবস্থানুযায়ী হইবে, যাহাতে তাহার আত্মা উন্নতির এক স্তর হইতে অন্য স্তরে ক্রমাগত উন্নতি লাভ করিতে পারে। ‘তাহারা চিরকাল সেখানে থাকিবে’ বাক্য দ্বারা বুঝা যায়, বেহেশ্‌তে প্রবেশকারীরা ক্ষয়প্রাপ্ত বা লয়প্রাপ্ত হইবে না। মানুষ যখন খাদ্য-গ্রহণ বা খাদ্য হজম করিতে পারে না, কিংবা যখন কেহ তাহাকে হত্যা করে, তখনই সে মৃত্যু বরণ করে। কিন্তু বেহেশ্‌তী ব্যক্তি যেহেতু নিজের জন্য ঠিক ঠিক ও উপযোগী খাদ্য লাভ করিবে এবং যেহেতু পবিত্র ও শান্তিপ্রিয় বহু সঙ্গী সাথী লাভ করিবে, সেইজন্য ক্ষয় বা বিনাশ তাহার নাগাল পাইবে না।

মো’মেনগণ বেহেশ্‌তে নিজের নিজের জোড়া স্বরূপ স্ত্রী বা স্বামী লাভ করিবে। একজন ভাল জীবন-সঙ্গী বা জীবন-সঙ্গিনী কতইনা শান্তি ও আনন্দের হইয়া থাকে! বিশ্বাসীরা ইহকালেও ভাল,পবিত্র স্বামী বা স্ত্রী পাইবার চেষ্টা করে। তাহারা পরলোকে তাহা পাইবেই। তথাপি এই কথা না বলিয়া উপায় নাই যে, এই আশীর্বাদ সমূহ শারীরিক ও বস্তুগত নহে। বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যার জন্য সূরা তূর, সূরা রাহমান ও সূরা ওয়াক্বিয়া দেখুন।