৪৪

কুরআনের অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা, কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি স্থানে বর্ণিত হইয়াছে, যথাঃ ২ঃ২৪, ১০ঃ৩৯, ১১ঃ১৪, ১৭ঃ৪৯, ৫২ঃ৩৪-৩৫। এই পাঁচটির মধ্যে দুইটি স্থানে (২ঃ২৪ এবং ১০ঃ৩৯) একই ধরণের চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইয়াছে। অন্য তিনটি স্থানে তিনটি ভিন্ন প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ দিয়া, অবিশ্বাসীগণকে মোকাবেলার আহবান জানানো হইয়াছে। চ্যালেঞ্জের ধরণের মধ্যে এই যে বিভিন্নতা, তাহা আপাতদৃষ্টিতে সামঞ্জস্যহীন মনে হইতে পারে, কিন্তু তাহা নহে। প্রকৃত পক্ষে, চ্যালেঞ্জের আয়াতগুলিতে এমন কতকগুলি দাবী আছে, যেগুলি চিরস্থায়ী। তাই হযরত রসূলে পাক (সাঃ)-এর সময়ে যেমন বিভিন্ন আকারে এই চ্যালেঞ্জগুলি বলবৎ ছিল, তেমনি আজও সেইগুলি সমভাবেই বলবৎ রহিয়াছে।

চ্যালেঞ্জগুলির বিভিন্ন ধরণকে ব্যাখ্যা করার পূর্বে, ইহা জানাইয়া দেওয়া প্রয়োজন যে, কুরআনের যে সব স্থলে এই মোকাবেলার আহবান (চ্যালেঞ্জ) জানানো হইয়াছে, সেই সেই স্থলে সঙ্গে সঙ্গে ধন-দৌলত ও শক্তি মত্তার উল্লেখ রহিয়াছে। তবে, এই আয়াতটিতে এর ব্যতিক্রম রহিয়াছে, কেননা এই আয়াতটি ১০ঃ৩৯ আয়াতের পুনরুল্লেখ মাত্র। ইহা হইতে একটি সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হওয়া যায় যে, ধন-দৌলত ও ক্ষমতার সাথে, কুরআনের অনুরূপ কিংবা ইহার অংশ বিশেষের অনুরূপ আয়াতাদি রচনার চ্যালেঞ্জের মধ্যে, কোন না কোনভাবে, একটা যোগসূত্র রহিয়াছে। যোগসূত্রটি এই কথার মধ্যে রহিয়াছে যে, কুরআনকে অমুসলমানদের কাছে অমূল্য ধন রূপে তুলিয়া ধরা হইয়াছে। অবিশ্বাসীরা মহানবী (সাঃ)-এর কাছে ধন-দৌলত ও অর্থ সম্পদাদি দাবী করিত (১১ঃ১৩), ইহার উত্তরে বলা হইয়াছে যে, তিনি (সাঃ) কুরআনের আকারে যে মহাসম্পদ লাভ করিয়াছেন তাহা তুলনা বিহীন। তাহারা এই প্রশ্নও উত্থাপন করিত যে, রসূলে পাক (সাঃ)-এর কাছে কোনও ফিরিশ্‌তা আসে না কেন (১১ঃ১৩)? ইহার উত্তরে বলা হইয়াছে যে ফিরিশ্‌তা নিশ্চয় রসূলেপাক (সাঃ)-এর কাছে আসিয়াছেন এবং তাহারা তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বরূপ তাঁহার (সাঃ) কাছে আল্লাহ্‌র বাণীও পৌঁছাইয়া দিতেছেন। এইভাবে, অবিশ্বাসীদের দাবী ‘ধন-সম্পদ আন ও ফিরিশ্‌তা দেখাও’—এই দুইটি দাবীরই উত্তর কুরআনে একসাথে দেওয়া হইয়াছে যে, কুরআনই ফিরিশ্‌তার মাধ্যমে আনীত অতুলনীয় ধন, যাহার অনতিক্রমনীয় শ্রেষ্ঠত্বের মোকাবেলা করা কাহারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখন চ্যালেঞ্জ-সম্বলিত বিভিন্ন আয়াতগুলি পৃথক পৃথকভাবে পর্যালোচনা করা যাক। সবচেয়ে বড় দাবী করা হইয়াছে ১৭ঃ৮৯ আয়াতে, যেখানে অবিশ্বাসীগণকে সারা কুরআনের অনুরূপ সর্বগুণসম্পন্ন একখানা কিতাব রচনার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইয়াছে। এই চ্যালেঞ্জে তাহাদিগকে বলা হয় নাই যে, তাহাদের কিতাবকে আল্লাহ্‌র বাণী রূপে উপস্থাপন করিতে হইবে। তাহাদের নিজের লিখা কিতাব হিসাবে ইহা উপস্থাপন করিয়া ঘোষণা করিতে হইবে যে, ইহা কুরআনের সমকক্ষ বা কুরআন হইতে উত্তম। কিন্তু যেহেতু, সম্পূর্ণ কুরআন তখনও অবতীর্ণ হয় নাই, অতএব, সমস্ত কুরআনের মোকাবিলা করার প্রশ্ন তাৎক্ষণিক ছিল না, বরং এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি ভবিষ্যদ্বাণী এইভাবে অন্তর্নিহিত রহিয়াছে যে, অবিশ্বাসীরা কস্মিন কালেও কুরআনের সমকক্ষ কোন কিতাব রচনা করিতে সক্ষম হইবে না। অসম্পূর্ণ অবস্থায় কুরআন উক্ত চ্যালেঞ্জের সময় যতটুকু ছিল, ততটুকুরও না এবং সম্পূর্ণ হইবার পর যতটুকু হইল, ততটুকুরও না। এই চ্যালেঞ্জ শুধু রসূলে পাক (সাঃ) এর জীবদ্দশায় যেসব অবিশ্বাসী ছিল, তাহাদের জন্যই সীমাবদ্ধ নহে বরং অনাগত ভবিষ্যতের অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী ও সমালোচকদের সকলের জন্যই ইহা প্রকাশ্য চ্যালঞ্জ হিসাবে বিদ্যমান রহিয়াছে। ১১নং সূরার ১৪ আয়াতে দশটি সূরার সমকক্ষতা করার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইয়াছে, ইহার কারণ এই যে, অবিশ্বাসীরা তখন সমস্ত কুরআনের উপর আপত্তি উত্থাপন না করিয়া, কয়েকটি অংশ বিশেষের সমালোচনা করিয়া আপত্তি জানাইয়াছিল। তাই এই ক্ষেত্রে তাহাদিগকে সমস্ত কুরআন মোকাবিলার আহ্বান না জানাইয়া, দশটি সূরা রচনা করিবার আহ্বান করা হইল যাহা তাহাদের অনুমিত দোষ-যুক্ত কুরআনী অংশগুলির সমকক্ষতায় টিকিতে পারিবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৭ঃ৮৯ তে সমস্ত কুরআনকে একটি পরিপূর্ণ ক্রুটি বিচ্যুতিহীন কিতাব বলিয়া দাবী করা হইয়াছে, অতএব, সেখানে সমস্ত কুরআনের মোকাবিলায় উহারই মত সর্বাংশে সমকক্ষ কিতাব আনার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু ১১ঃ১৪ তে যে চ্যালেঞ্জ আছে, তাহার মূল কারণ ছিল অবিশ্বাসীদের এই দাবী যে, কুরআনের স্থানে স্থানে ভুল-ভ্রান্তি ও দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান; সমস্ত কুরআনেই দোষ-ত্রুটি রহিয়াছে বলিয়া তাহারা এই ক্ষেত্রে দাবী করে নাই। অতএব, তাহাদিগকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইল, তাহারা যে কোন দশটি সূরা যাহা ক্রুটিপূর্ণ বলিয়া তাহারা মনে করে, তাহারই সমকক্ষতা করিয়া যেন দেখাইয়া দেয়। দশম সূরার ৩৯ আয়াতে অবিশ্বাসীদিগকে কুরআনের যে কোন একটি মাত্র সূরার মোকাবিলা করিতে বলা হইয়াছে। ইহার কারণ এই যে, উপরে উল্লেখিত সূরার দুই আয়াতের মত, এখানে অবিশ্বাসীদের কোন অনুযোগের প্রেক্ষিত অনুপস্থিত। এখানে কুরআন নিজের পরিপূর্ণতার দাবী নিজের তরফ হইতেই উত্থাপন করিতেছে, অবিশ্বাসীদের অনুযোগে বা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নয়। দশম সূরার ৩৮ আয়াতে কুরআন দাবী করিয়াছে যে, ইহার (কুরআনের) পাঁচটি অতিশয় উচ্চ স্তরের গুণ রহিয়াছে। এই দাবীর সমর্থনে পরবর্তী; (৩৯ আয়াতে), অস্বীকারকারী সংশয়বাদীগণকে চ্যালেঞ্জ করা হইয়াছে তাহারা যেন ঐ পাঁচটি গুণ-সম্বলিত (দশম সূরার মত) একটি সূরাই রচনা করিয়া জন-সমক্ষে হাযির করে। আলোচ্য আয়াতে (২ঃ২৪) পঞ্চম বারের মত চ্যালেঞ্জ দেওয়া হইয়াছে। এখানেও দশম সূরার ৩৯ আয়াতের মতই, অবিশ্বাসীগণকে চ্যালেঞ্জ করা হইয়াছে কোনও সূরার মত একটি সূরা তৈরী করিয়া আনিতে। এই চ্যালেঞ্জের পূর্বের আয়াতে এই দাবী করা হইয়াছে যে, ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণকে কুরআন পথ দেখাইয়া ও পথে চালাইয়া নিয়া আধ্যাত্মিকতার উচ্চমার্গে পৌঁছাইয়া দেয়। অবিশ্বাসীগণকে বলা হইতেছে যে, তাহারা যদি কুরআনকে ঐশী বাণী বলিয়া বিশ্বাস না করে, তাহা হইলে যে কোন একটি সূরার সমকক্ষ সূরা তাহারা রচনা করিয়া দেখাইয়া দেউক যাহা পাঠক বা অনুসারীর মনকে সমভাবে আধ্যাত্মিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত করিতে পারে।

উপরোক্ত ব্যাখ্যা হইতে বুঝা যায়, এই চ্যালেঞ্জগুলির একটি অপরটি হইতে পৃথক, কোনটিই পরস্পরবিরোধী নহে। প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জ স্বকীয় স্থানে বলবৎ রহিয়াছে এবং চিরকালের জন্য বলবৎ থাকিবে। যেহেতু কুরআন পবিত্রতম ও উচ্চাঙ্গীন ভাবধারার বাহক, সেই কারণে ইহার রচনাশৈলী ও সাহিত্যিক গুণাবলী সর্বোচ্চ স্তরের হওয়া অপরিহার্য ছিল, যাহাতে বিষয়বস্তু ও ভাবধারার স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা কোনদিক দিয়া ম্লান না হয় এবং কুরআনের বিমল ও পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ব্যাহত ও ক্ষুন্ন না হয়। তাই অবিশ্বাসীগণকে কুরআনের মত বা কুরআনের সমকক্ষ কিতাব রচনার চ্যালেঞ্জ যে আকারেই দেওয়া হউক না কেন, বিষয়-বস্তু, আদর্শ ও ভাবধারা এবং রচনা-শৈলী ও প্রকাশ-ভঙ্গি ইত্যাদি সব কিছুই এই চ্যালেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হইয়া রহিয়াছে।