১৬

১৬। ‘আলিফ লাম মীম’—প্রত্যেকটি অক্ষর এক একটি শব্দকে বুঝাইয়াছে। স্ব-স্ব উচ্চারণে পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারিত অক্ষরগুলি সংক্ষিপ্ত শব্দ বিশেষ। ইহাদিগকে শব্দ-সংক্ষেপণ বলা যাইতে পারে। আরবীতে এইরূপ পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারিত ও ব্যবহৃত অক্ষর-সমষ্টিকে ‘হুরূফে মুকাত্তায়াত’ বলা হয়। কুরআনের ২৮টি সূরার প্রারম্ভে এই মুকাত্তায়াতের ব্যবহার আসিয়াছে। একটি হরফ হইতে আরম্ভ করিয়া, বিভিন্ন হরফ একত্রে সন্নিবিষ্ট হইয়া, ‘মুকাত্তায়াত’ রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। এইরূপে সন্নিবিষ্ট অক্ষরের সর্বোচ্চ সংখ্যা পাঁচ। মোট চৌদ্দটি হুরূফে মুকাত্তায়াত রূপে ব্যবহৃত হইয়াছেঃ আলিফ, লাম, মীম্, সোয়াদ, রা, কাফ, হা, ইয়া, আইন, তা, সিন, হা, কাফ এবং নূন। কাফ ও নূন একা একা যথাক্রমে সূরা কাফ ও সূরা কলমের প্রারম্ভে ব্যবহৃত হইয়াছে। অন্যান্য অক্ষরগুলি দুই বা ততোধিক মিলিয়া সম্মিলিতভাবে, অন্য কতকগুলি সূরার প্রারম্ভে ‘মুকাত্তায়াত’ রূপে স্থান পাইয়াছে। আরবদের মধ্যে এই মুকাত্তায়াতের ব্যবহার পূর্ব হইতেই ছিল। তাহারা তাহাদের কবিতায় ও কথাবার্তায় মুকাত্তায়াত ব্যবহার করিত। একজন আরব কবি বলেন, ‘কুল্‌না কিফি লানা, ফাকালাত্ কাফ্‌’ অর্থাৎ স্ত্রীলোকটিকে বলিলাম, একটু থামুন, তিনি বলিলেন, আমি থামিতেছি। এখানে ‘কাফ’ অক্ষরটি ‘ওয়াকাফতু’ (থামিতেছি) শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হইয়াছে। আধুনিক কালের পশ্চিমা দেশগুলিতে এবং তাহাদের অনুকরণে প্রাচ্যের দেশগুলিতেও এই শব্দ-সংক্ষেপণ রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হইয়াছে। সকল অভিধানেই ইহার একটি লিষ্ট ইদানীং সংযোজিত হইয়া থাকে। মুকাত্তায়াত আল্লাহ্‌র গুণাবলী প্রকাশক শব্দসমূহের অক্ষর সংকেত স্বরূপ। যে সূরার পূর্বে এই অক্ষর-সংকেত ব্যবহৃত হয়, ইহার বিষয়-বস্তুর সাথে আল্লাহ্‌তা’লার কোনও না কোন গুণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। মুকাত্তায়াতের অক্ষরে ঐ গুণটিই নিহিত থাকে। বিভিন্ন সূরার প্রারম্ভে সাংকেতিকভাবে ব্যবহৃত অক্ষরগুলি যেন তেন বা অসাজানোভাবে স্থাপন করা হয় নাই। যেখানে একত্রে একাধিক অক্ষরের সমাবেশ আছে, সেখানেও সুশৃঙ্খলা বিদ্যমান আছে, আগের অক্ষর পরে কিংবা পরের অক্ষর আগে রাখা হয় নাই। বিভিন্ন সমষ্টি বা সেটের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক ও গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে এবং যে যে অক্ষর দ্বারা একটি সমষ্টি বা সেট গঠিত হইয়াছে উহারাও একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পালন করিতেছে। যেসব সূরা মুকাত্তায়াত দ্বারা আরম্ভ হয় নাই, তাহারা পূর্ববতী সন্নিহিত মুকাত্তায়াত-সম্বলিত আয়াতের আওতাধীন থাকিয়া, উহারই বিষয়বস্তু, বাকধারা ও ভাবধারা অনুসরণ করে। মুকাত্তায়াতের তাৎপর্যসমূহের মধ্যে দুইটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য বলিয়া মনে হয়ঃ (১) প্রত্যেক অক্ষরের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা-মূল্য আছে (জরীর) আলিফ, লাম, মীম্‌, মিলিয়া সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ (আলিফ-১, লাম-৩০ এবং মীম্‌-৪০)। এমতাবস্থায় সূরার প্রারম্ভে আলিফ লাম মীম্ ব্যবহারের তাৎপর্য ইহা হইতে পারে যে, এই সূরাতে যে বিষয় বিবৃত হইয়াছে (ইসলামের প্রতিষ্ঠার পর প্রাথমিক স্থিতিশীলতা) তাহা সম্পাদিত হইতে ৭১ বৎসর সময় লাগিবে, (২) আল্লাহ্‌র নির্দিষ্ট গুণাবলী-জ্ঞাপক শব্দ-সংক্ষেপ (যাহাতে একটি অক্ষর দ্বারা একটি শব্দ নির্দেশ করে) যেমন পূর্বেই বলা হইয়াছে, মুকাত্তায়াত যুক্ত সূরার বিষয়-বস্তু আল্লাহ্‌তা’লার ঐ গুণাবলীর সাথে সম্বন্ধ রাখে, যে গুণগুলি সংশ্লিষ্ট সূরার মুকাত্তায়াতের মধ্যে নিহিত আছে।এখানে মুকাত্তায়াত হিসাবে ‘আলিফ লাম মীম্‌’ ব্যবহৃত হইয়াছে, যাহার অর্থ করা হইয়াছে ‘আমি আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ’। হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত ইবনে মাস্উদ (রাঃ) এই অর্থ করিয়াছেন। এখানে ‘আলিফ মানে ‘আনা’, লাম মানে ‘আল্লাহ’, মীম্ মানে আ’লামু, সব মিলাইয়া হয়, ‘আনাল্লাহু আ’লামু’ (আমি আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ)। কাহারও কাহারও মতে, ‘আলিফ’ মানে আল্লাহ্‌, লাম মানে জিব্‌রাঈল, আর ‘মীম্‌’ মানে মুহাম্মদ (সাঃ), যাহার তাৎপর্য হইল—এই সূরার মূল বিষয়-বস্তু সম্পর্কিত ঐশী জ্ঞান আল্লাহ্‌র কাছ হইতে জিব্‌রাঈলের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সাঃ)কে দেওয়া হইয়াছে। এই শব্দ-সংক্ষেপ বা মুকাত্তায়াত কুরআনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাহা ওহীর মাধ্যমে আসিয়াছে (বুখারী)।