সূরা ফাতেহার মাঝে শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের এক অনাবিল সৌন্দর্য ও অনুপম সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। সূরাটি দুইভাগে বিভক্ত। প্রথমার্ধ আল্লাহ্ সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয়ার্ধ মানুষ (বান্দা) সম্পর্কিত। প্রথমার্ধের অংশগুলি দ্বিতীয়ার্ধের অংশগুলির সাথে এক চমৎকার, নিগূঢ় যোগ সূত্রে বাঁধা। প্রথমার্ধের সর্বগুণাধার ‘আল্লাহ্’ নামটির সাথে, দ্বিতীয়ার্ধের মানবাকুতি ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি’ বাক্যটির অপূর্ব সম্পর্ক সংযোগ রহিয়াছে। যখনই বিশ্বাসী ভক্ত ভাবে যে, কত মহামহিম, কত পূত-পবিত্র ত্রুটি-বিচুতি-বিবর্জিত, সর্বগুণের পরিপূর্ণ আধার সেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্, তখনই তাহার হৃদয়ের অন্তঃস্থল হইতে আপনা-আপনি ধ্বনিত হইয়া উঠে এই আওয়াজ, প্রভু! আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি। প্রথমার্ধের আল্লাহ্র গুণ ‘বিশ্ব সমূহের প্রতিপালক প্রভু’ এর সাথে যোগাযোগ রহিয়াছে দ্বিতীয়ার্ধের আমরা একমাত্র তোমরাই সাহায্য প্রার্থনা করি’ বাক্যটির। যখন মানুষ বুঝিতে পারে যে, আল্লাহ্তা’লাই তাহার ও বিশ্বসমূহের পালনকর্তা, বদ্ধনকর্তা ও উন্নতিদাতা, তখন সে কালবিলম্ব না করিয়া তাঁহার সাহায্যের আশ্রয় নিতে ধাবিত হয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত বলিয়া উঠে ‘আমরা একমাত্র তোমরাই সাহায্য চাই। আল্লাহ্র ‘আর্-রাহমান’ গুণের সাথে সংযোগ আছে দ্বিতীয়ার্ধে এই মানব প্রার্থনার ‘আমাদিগকে সরল-সুদৃঢ় পথে চালিত কর’। ‘আর্-রাহমান’ এর সংক্ষিপ্ত অর্থ হইল, ‘অসীম অনুগ্রহ বর্ষণকারী, যিনি অযাচিত ভাবে আমাদের প্রয়োজন মিটান।’ আল্লাহ্র এই গুণ স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে, মানব মনে স্বাভাবিক ভাবেই সাধ জাগে, সে যেন অনিশ্চিত ও অন্ধকারময় জীবন পাড়ি দিবার জন্য সঠিক ও আলোক-দীপ্ত পথ প্রাপ্ত হয়, যাহা একমাত্র ‘আর্-রাহমানই’ নবী পাঠাইয়া তাহার মাধ্যমে ওহী দ্বারা প্রবর্তিত করিয়া থাকেন। প্রথমার্ধের ‘আর্-রাহীম’ গুণের সাথে (আর-রাহীম মানে, মানুষের কাজ কর্মের উত্তম পুরস্কারদাতা) দ্বিতীয়ার্ধের ‘ঐ সকল পুরস্কারপ্রাপ্তদের পথে চালাও’ বাক্যটির সম্বন্ধ রহিয়াছে। কেননা, ‘আর্-রাহীম’ই তাঁহার যোগ্য ও উপযুক্ত বান্দাগণের উপর পুরস্কার ও অনুগ্রহ বর্ষণ করিয়া থাকেন। একই ভাবে আমরা প্রথমার্ধের আল্লাহ্র একটি গুণ জানিতে পারি যে, তিনি ‘বিচার দিনের মালিক’। আর দ্বিতীয়ার্ধে পাই এই ‘বিচারদিনের মালিকের’ প্রতি তাঁহার মানব-বান্দার মিনতি, ‘যাহারা তোমার কোপগ্রস্ত ও পথভ্রষ্ট হইয়াছে, আমাদিগকে তাহাদের পথে নিও না।’ মালিকের কাছে বান্দাকে কাজের হিসাব দিতে হইবে, এই কথা ভাবিলেই বান্দার মনে স্বভাবতঃ ভয়ের উদ্রেক হয়, কোথায় কি ভুল ধরা পড়ে। তাই সে মালিকের কাছে প্রথম হইতে প্রার্থনা করিতে থাকে যাহাতে তাহাকে ভ্রান্তির পথ হইতে এবং কোপগ্রস্ত হওয়ার পথ হইতে রক্ষা করেন। এই সূরার প্রার্থনাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হইল এই যে, ইহা অতি স্বাভাবিক ভাবে মানুষের হৃদয়-তন্ত্রীতে ঝংকার তুলে। মানুষের প্রকৃতিতে আনুগত্য স্বীকারের প্রেরণা সৃষ্টির জন্য দুইটি মৌলিক চালিকাশক্তি নিহিত আছে। তার একটি হইল ভালবাসা এবং অপরটি হইল ভয়। কেহ আছে, ভালবাসায় অভিভূত হয়। আর কেহ কেহ আছে, যাহারা ভয় ও ভীতির মাধ্যমে বশে আসে। ভালবাসা নিশ্চয় মহত্তর গুণ। কিন্তু এমন লোকও থাকিতে পারে এবং নিশ্চয় আছে যাহারা ভালবাসা দ্বারা প্রভাবিত হয় না, তাহাদিগকে বশে আনার একমাত্র অস্ত্র ভয়। সূরা ফাতেহাতে মানব-প্রকৃতির এই উভয় চালিকা শক্তি ব্যবহার করা হইয়াছে। তাই, প্রথমে আল্লাহ্তা’লার ঐ গুণবাচক নামগুলির উল্লেখ রহিয়াছে যাহা ভালবাসাকে জাগাইয়া তুলে, যেমন ‘বিশ্বের সৃষ্টিকারী ও প্রতিপালন কারী, অযাচিত-অসীম দাতা এবং পরম দয়াময়।’ অতঃপর, ভালবাসা উদ্দীপক গুণাবলীর সীমাতে যাইয়া ‘বিচার দিনের মালিক’ নামটি উচ্চারিত হইয়াছে। ইহা মানুষকে স্বরণ করাইয়া দিতেছে যে, সে যদি ভালবাসা দ্বারা প্রণোদিত হইয়া আত্মশুদ্ধির পথে না চলে, তাহা হইলে তাহাকে আল্লাহ্তা’লার কাছে জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। এমনিভাবে ভয়কেও ভালবাসার পাশাপাশি একটি চালিকা-শক্তিরূপে ব্যবহারে লাগানো হইয়াছে। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্তা’লার রহমত—দয়ার গুণ তাহার অন্যান্য সকল গুণের উর্ধ্বে এবং অন্যান্য সকল গুণকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে, তাই তাঁহারই এই ভীতি উৎপাদক মৌলিক গুণটিও তাঁহার দয়া-দাক্ষিণ্যের গুণে রঞ্জিত। বস্তুতঃ আল্লাহ্র করুণারাশি, তাহার ক্রোধকে ডিঙ্গাইয়া যায়। ‘মালিক’ শব্দটির মধ্যে ইহার আভাষ পাওয়া যায় এবং আমরা স্বস্তি বোধ করি যে, আমরা আইন-কানুনের অন্ধ অনুসারী একজন বিচারকের সম্মুখে হাযির হইতেছি না, বরং সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী এক শাহানশাহের সম্মুখে হাযির হইতেছি, যাহার ক্ষমা করার ক্ষমতা রহিয়াছে এবং যেখানে শাস্তিদান করা সম্পূর্ণরূপে অপরিহার্য সেখানে তিনি শাস্তি প্রদান করিবেন।
মোট কথা, সূরা ফাতেহা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। মাত্র সাতটি আয়াতের একটি সূরা, কিন্তু ইহা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটি সত্যিকার খনি। ইহা উম্মুল কিতাব বা গ্রন্থ-জননী বলিয়া আখ্যায়িত হইয়াছে। জননী যেমন আপন জঠরে সন্তানকে তাহার সকল অবয়বসহ ধারণ করেন, তেমনি সূরা ফাতেহার মধ্যে, বিস্তীর্ণ কুরআনের সারাংশ বিধৃত রহিয়াছে। সর্বপ্রকার মঙ্গল ও কল্যাণের উৎস আল্লাহ্র নাম নিয়া আরম্ভ করিয়া, এই সূরাটি প্রথমেই সেই আল্লাহ্তা’লার মৌলিক গুণাবলীর উল্লেখ করিয়াছে, যথাঃ (১) তিনি বিশ্বসমূহের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, (২) তিনি অযাচিত অসীম দাতা যিনি মানুষের জন্মের পূর্বেই, মানুষের চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে, তাহার জীবন ধারণের উপযোগী প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণাদির সরবরাহ নিশ্চিত করিয়াছেন; (৩) তিনি পরম দয়াময় যিনি মানুষের শ্রমের উৎকৃষ্টতম ফলোদয় ঘটান এবং তাহার শ্রমের তুলনায় বহুগুণ পুরস্কার ও বেশী বেশী ও বার বার প্রতিদান দিয়া থাকেন ও (৪) তিনি বিচার-দিনের একচ্ছত্র মালিক ও অধিপতি, যাঁহার কাছে প্রত্যেক মানুষকেই ইহকালীন কার্যাবলীর জন্য হিসাব দিতে হইবে, তিনি দুষ্কৃতকারীকে শাস্তি দিবেন বটে, কিন্তু বিচারকের আসনে বসিয়া নয় বরং সম্রাটের উচ্চাসনে বসিয়া। মালিকের শাস্তির মাঝে, বান্দার প্রতি তাহার যে স্বাভাবিক করুণা থাকে তাহাও একত্রিত হইয়া যায়। ক্ষমার মাধ্যমে সংশোধন ও সুফল লাভের সম্ভাবনা থাকিলে, মালিক বান্দাকে হয়ত ক্ষমাই করিবেন। ইসলাম ধর্মমতে, ইহাই আল্লাহ্র পরিচিতি, যাহা কুরআনের প্রারম্ভেই পেশ করা হইয়াছে। সেই আল্লাহ্তা’লার মহিমা, ক্ষমতা ও প্রভুত্বের যেমন কোনও সীমা পরিসীমা নাই, তেমনি তাঁহার করুণা, দয়া-দাক্ষিণ্য ও হিতৈষণারও কোন সীমা-পরিসীমা নাই। তাই মানুষের হৃদয় হইতে স্বতঃই উচ্চারিত হইয়া উঠে এই অপ্রতিরোধ্য ঘোষণা, ‘আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ যেহেতু উচ্চ মৌলিক গুণের একক অধিকারী, অতএব, আমি একমাত্র তাঁহারই সেবায় নিজেকে সমর্পণ করিতে প্রস্তুত, কেবল প্রস্তুতই নহি বরং তাঁহার সেবার জন্য অধীরভাবে আগ্রহী। কিন্তু আল্লাহ্তা’লা জানেন যে মানুষ দুর্বল। সে ভুল করিতে পারে। তাই তিনি নিজেই দয়া পরবশ হইয়া তাঁহার বান্দাকে শিখাইয়া দিয়াছেন যে, সে যেন তাহার অগ্রযাত্রার পথে সকল উপায় উপকরণ লাভের জন্য এবং সকল বাধাবিপত্তি অপসারণের জন্য পদে পদে অবিরাম আল্লাহ্র সাহায্য যাচনা করে। সূরাটির শেষে আছে মানুষের সুদূর প্রসারী ও সর্বকল্যাণকর, পূর্ণতম প্রার্থনাটি, যে প্রার্থনাতে মানুষ তাহার সৃষ্টিকর্তার কাছে ইহাই চাহে যে, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বস্তুগত ও অধ্যাত্মগত সার্বিক মঙ্গল প্রাপ্তির সরল-সুদৃঢ় পথটিতে যেন তাহাকে চালিত করা হয়। সে আল্লাহ্র কাছে কাতর স্বরে মিনতি করে, সে যেন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করিয়াই ক্লান্ত হইয়া না পড়ে বরং কৃতিত্বের সহিত আরও অগ্রসর হইয়া তাঁহার মনোনীতগণের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তাহাদের মতই অশেষ পুরস্কার ও অনুগ্রহরাজিতে ভূষিত হয়। সে আরো অনুনয় করে, সে যেন সরল-সুদৃঢ় এই পথটিতে অবিচল ভাবে চলিতেই থাকে যাহাতে সে তাহার প্রতিপালক প্রভু ও মালিকের নিকট হইতে নিকটতর হইয়া যাইতে পারে। যেরূপে পূর্ববর্তীগণের অনেকেই প্রভুর নৈকট্য লাভ করিয়াছিলেন, সেইরূপ সে-ও যেন নৈকট্য লাভ করিতে পারে। ইহাই কুরআনের উদ্বোধনী সূরার বিষয় বস্তু। ইহাই নানা ভাবে ও নানা আকারে পবিত্র গ্রন্থের সর্বত্র বারে বারে বিবৃত হইয়াছে।