৮৯

এই আয়াতের উল্লেখিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটি সেই সময়ে ঘটিয়াছিল, যখন আল্লাহ্‌র নির্দেশক্রমে হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈল জাতিকে ফেরাউনের কবল হইতে উদ্ধারের নিমিত্তে, ঐ জাতির সবাইকে নিয়া কেনান দেশের উদ্দেশ্যে রাত্রিযোগে মিশর ত্যাগ করিয়াছিলেন। বনী ইসরাঈল জাতি গোপনে রাত্রিযোগে মিশর হইতে পলায়ন করিয়াছে জানিতে পারিয়া ফেরাউন নিজের লোকজন ও সেনাবাহিনীসহ তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিল এবং দলবল সহ লোহিত সাগরে নিমজ্জিত হইল। এই আয়াতে বর্ণিত ঘটনার প্রকৃতি ও তাৎপর্য পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে এবং ইহা যে আল্লাহ্‌তা’লার সাহায্যের এক বিরাট ও স্থায়ী নিদর্শনবিশেষ তাহা ভালরূপে বুঝিতে হইলে, এই আয়াতটির সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত যথা ২০ঃ৭৮, ২৬ঃ৬২-৬৪, ৪৪ঃ২৫ মিলাইয়া পড়া দরকার। এই আয়াতগুলি পাঠে, নিম্নলিখিত সত্য উদঘাটিত হইয়া থাকে; (ক) যখন মূসা (আঃ) হস্তস্থিত লাঠিদ্বারা সমুদ্রজলে আঘাত করিলেন, যেরূপ কুরআনে বর্ণিত হইয়াছে, অথবা যখন মূসা (আঃ) সমুদ্রের দিকে হস্তকে প্রসারিত করিয়া তুলিয়া ধরিলেন, যেরূপে বাইবেলে বর্ণিত হইয়াছে, তখন সমুদ্রে ভাটার সময় ছিল, পানি দ্রুত কমিতেছিল এবং পারাপারের স্থানটি প্রায় শুকাইয়া গিয়াছিল; (খ) আল্লাহ্‌তা’লা মূসা (আঃ)-কে তাড়াতাড়ি শুষ্ক সমুদ্র পাড়ি দিবার নির্দেশ দিলেন এবং মূসা (আঃ) সেই নির্দেশ পালন করিলেন, (গ) কিন্তু ফেরাউনের দল যখন আসিয়া সমুদ্রসৈকতে পৌঁছিল, তখন জোয়ার আসিতেছিল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া, বনী ইসরাঈলকে যথাশীঘ্র ধরিয়া ফেলিবার বাসনাতিশয্যে তাহারা পানির মধ্যেই নামিয়া চলিতে লাগিল; (ঘ) ফেরাউনের সেনাবাহিনীতে বড় বড় রথ ও ভারী যুদ্ধাস্ত্র থাকার কারণে মনে হয়, পানির মধ্যে চলায় তাহাদের গতি মন্থর হইয়া পড়িয়াছিল এবং সে কারণেই মধ্য সমুদ্রে পৌঁছাইতে না পৌছাইতেই ভরা জোয়ার আসিয়া তাহাদিগকে ডুবাইয়া দিল। মুসা (আঃ) কর্তৃক লাঠিদ্বারা সমুদ্রজলে আঘাত করার ফলেই যে সমুদ্র দুইভাগে বিভক্ত হইয়া তাঁহার দলের জন্য পারাপারের রাস্তা করিয়া দিল,এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কেবল একটি ঐশী নিদর্শনরূপে মূসা (আঃ) ঐশী-সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন যে, এখনই ভাটার উপযুক্ত সময় যখন তাঁর দলবলের সমুদ্র অতিক্রম করা উচিত। তাই মূসা (আঃ) এই আদেশ অনুযায়ী সমুদ্র জলে আঘাত করিয়া তাহাদিগকে তাড়াতাড়ি সমুদ্র অতিক্রম করার নির্দেশ দিয়া, নিজে আগে আগে চলিতে লাগিলেন। সকল বিষয় আল্লাহ্‌তা’লা এমনিভাবে ঘটাইয়াছিলেন যে, মূসা (আঃ) যখন সমুদ্র তীরে পৌছিলেন, তখন ভাঁটার সময় ছিল এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশক্রমে তিনি সমুদ্রজলে লাঠির আঘাত করিলে পানিও তখন কমিতে শুরু করিল এবং ওপারে যাইবার পথ সুগম হইয়া গেল। ঐ লাঠির আঘাত ও পানি কমিতে শুরু করা একই সময়ে একসাথে সংঘটিত হইল। ইহা মু’জেযা বা অলৌকিক ঘটনা, এই কারণেই যে, একমাত্র আল্লাহ্‌তা’লাই জানিতেন সমুদ্রে কখন ভাঁটার সময় হইবে এবং সেই সময় আসা মাত্র মূসা (আঃ)-কে তাহা জানাইয়া নির্দেশ দিলেন, ‘পানিতে লাঠি দ্বারা আঘাত কর।’

মূসা (আঃ) মিশর হইতে কেনান গমনকালে লোহিত সাগরের ঠিক কোন স্থানটি দিয়া অতিক্রম করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, ওয়াদি তামসিলাত বা তামসিলাৎ উপত্যকার গোশেন অঞ্চলে যেখানে ফেরাউনের রাজধানী ছিল (এনসাইক্লো বিব্লিকা, ভলিউম ৪, কলাম ১৪, রামসিস দেখুন), সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া মূসা (আঃ) তামসা উপসাগর অতিক্রম করিয়াছিলেন (এন সাই, বিব, কলাম ১৪৩৮-৩৯)। অন্যেরা মনে করেন যে, তিনি আরো অনেক দূর উত্তর দিকে যোয়ান নামক স্থান অতিক্রম করিয়া কেনানের নিকটবর্তী ভূমধ্যসাগরের কাছে সমুদ্র অতিক্রম করিয়াছিলেন (এনসাইক্লো বিব্লিকা, কলাম,১৪৩৮)। কিন্তু খুব সম্ভব মূসা (আঃ)-এর সময়ে, ফেরাউনের রাজধানী ছিল তাল-আবি-সোলায়মান এবং সেখান হইতে বনী ইসরাঈলগণ প্রথমে উত্তর পূর্ব দিকে তিম্‌সা উপসাগরের তীরে পৌঁছে, কিন্তু সেখানে দ্বীপ ও উপসাগরের বেড়াজাল ডিঙ্গাইয়া যাওয়া সম্ভব নয় দেখিয়া তাহারা দক্ষিণে চলিয়া আসে এবং সুয়েজ খালের নিকটবর্তী কোন স্থানে লোহিত সাগরকে মাত্র ২/৩ মাইল প্রশস্ত পাইয়া অপর পারে ‘কাদাসের’ দিকে রওয়ানা হইয়া যায় (এনসাইক্লো বিব কল ১৪৩৭)। ইসরাঈলীরা তাহার (মূসার) সহিত পালাইয়া গোশেন জলাভূমি অতিক্রম করিয়া সিনাই উপদ্বীপে আসিল। লোহিত সাগর (ইয়াস্ সূফ সমূদ্র বা খাগ্‌ড়ার সরোবর) অতিক্রম বলিতে বর্তমান লোহিত সাগরের কয়েক মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি হ্রদের শেষ দক্ষিণ প্রান্ত অতিক্রম করাকে বুঝাইতে পারে। সৈকতের বহুদূর বিস্তৃত এলাকা প্রবল বাতাসের কারণে পানিশূন্য অবস্থায় ছিল, এই অবস্থায় ফেরাউন বাহিনী পলাতকদের পিছু ধাওয়া করিলে, তাহাদের রথের চাকা ইত্যাদি ভিজা মাটির মধ্যে দাবিয়া যায়; ইত্যবসরে বাতাসের প্রাবল্য কমিয়া গেলে, পানি প্রবল বেগে ফিরিয়া আসিয়া ঐ বাহিনীর উপর ঝাপটাইয়া পড়ে। ইসরাঈলীরা কোন রাস্তা অবলম্বন করিয়াছিল, সেটা নিয়াও লেখকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, তাহারা দক্ষিণে, বর্তমান সিনাই পর্বত মালায়, আসিয়া লোহিত সাগরের পূর্বতীর ধরিয়া আকাবা উপসাগরের উত্তরে ইযিয়ন-জেবারে পৌঁছায়। অন্যেরা মনে করেন, মক্কা যাত্রী হাজীগণ ইযিয়ন-জেবারের পূর্বদিকে যেপথে এখনও গমন করিয়া থাকেন, সেই পথ ধরিয়া ইযিয়ন-জেবারের কাছে পৌঁছায়, তাহারা উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়া কাদেশ (বার্নিয়া) অঞ্চলে সিনাই পাহাড়ে আসে অথবা আকাবা উপসাগরের পূর্ব দিক বাহিয়া দক্ষিণ দিকে গমন করতঃ হরেব টিলায় উপনীত হয়। ঐতিহ্যগত বর্ণনাগুলির পার্থক্য এত বেশী যে, সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব (পীকের ভাষ্যঃ বাইবেল)।