‘দীন’ মানে প্রতিদান বা পুরস্কার, বিচার বা হিসাব-নিকাশ; রাজত্ব বা শাসনকর্তৃত্ব, অনুবর্তিতা, ধর্ম ইত্যাদি (আকরাব, লেইন)।

আল্লাহ্‌তা’লার চারিটি গুণ, যথা ‘সমগ্র বিশ্বের প্রভু’, ‘অযাচিত-অসীম দাতা’, ‘পরম দয়াময়’ এবং ‘বিচার দিনের মালিক’—এই চারটিই আল্লাহ্‌তা’লার মূল বা আদি গুণ। আল্লাহ্‌তা’লার অন্যান্য গুণাবলী, এই চারটি মূল গুণের ব্যাখ্যা বা শাখা-প্রশাখা মাত্র। অন্য গুণগুলি এই চারিটি গুণের বিশ্লেষণকারী। এই চারটি মৌলিক গুণ, চারিটি স্তম্ভ স্বরূপ, যাহার উপর আল্লাহ্‌র আরশ বা আসন স্থাপিত। য়ে ধারাবাহিকতায় এই চারিটি গুণের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহা, মানুষের কাছে আল্লাহ্‌তা’লা যে পর্যায়ক্রমে স্বীয় গুণাবলী প্রকাশ করেন, সেই পর্যায়ক্রমের উপর আলোকপাত করে।

‘রাব্বুল আলামীন’ (বিশ্বসমূহের প্রতিপালক, প্রভু) গুণের তাৎপর্য এই যে, মানব সৃষ্টির সাথে সাথে, তিনি প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতাও সৃষ্টি করিয়াছেন, যাহাতে মানুষ আধ্যাত্মিক উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করিতে পারে। ইহার পরে পরেই ‘আর্‌-রাহমান’ গুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয় যাহার মাধ্যমে, প্রকৃত পক্ষে, আল্লাহ্‌তা’লা মানুষকে তাহার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির উপায় ও উপকরণসমূহ দান করেন। আর যখন মানুষ ঐসব উপায় উপকরণের সদ্ব্যবহার করে তখন ‘আর্‌-রাহীম’ গুণটি কার্যকরী হয় এবং তাহাকে কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। সর্বশেষে, ‘মালিকে ইয়াউমিদ্দীন’ (বিচার দিবসের মালিক বা সর্বাধিপতি) নামক গুণটি মানুষের পরিশ্রমের শেষ ও সার্বিক ফলাফল ঘোষণা করে এবং এইভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণতা লাভ করে। যদিও চরম ও পূর্ণ হিসাব-নিকাশ পরকালের বিচারের দিনেই সম্পন্ন হইবে, তথাপি ইহকালেও প্রতিফলন প্রাপ্তির প্রক্রিয়া চলিতেছে। তবে, তফাৎ এই যে, ইহকালে মানুষের কাজকর্মে বিচার ও পুরস্কার দান অন্য মানুষের দ্বারা, রাজা-বাদশা দ্বারা অথবা শাসকদের দ্বারা সম্পন্ন হয় এবং সেজন্য তাহাতে ভুল-ভ্রান্তির আশংকা থাকে। শেষ বিচারের দিনে, আল্লাহ্‌তা’লার একক কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ পাইবে এবং প্রতিদান ও পুরস্কার প্রদান একমাত্র তাঁহারই হাতে ন্যস্ত থাকিবে। কাজেই সেখানে ভুল-ভ্রান্তি থাকবে না, অযথা শাস্তি বা অযথা পুরস্কারও থাকবে না। ‘মালিক’ শব্দটি স্পষ্ট বলিয়া দিতেছে যে, তিনি সাধারণ বিচারকের মত নহেন, যিনি সংশ্লিষ্ট আইনের গণ্ডীর ভিতরে থাকিয়া, নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ আইন-কানুন মোতাবেক বিচার করেন এবং এইরূপ করিতে বাধ্য। মালিকের সর্বময় কর্তৃত্ব খাটাইয়া আল্লাহ্ যাহাকে ইচ্ছা যেকোনও ভাবে, যে কোন স্থানে, যে কোনও সময়, ক্ষমা করিতে পারেন, দয়া দেখাইতে পারেন। এখানে ‘দীন’ শব্দটির অর্থ যদি ‘ধর্ম’ গ্রহণ করা হয়, তাহা হইলে, অর্থ দাঁড়াইবে ‘ধর্মের সময়ের প্রভু’ যাহার তাৎপর্য হইবে যখন ধর্ম অবতীর্ণ হইবার সময় আসে, তখন মানুষ ঐশী শক্তি নিচয়ের ও ঐশী সিদ্ধান্ত সমূহের অপূর্ব ঘটনাবলী দেখিতে পায় এবং ঐশী নিদর্শনসমূহ চূর্তদিকে ছড়াইয়া পড়ে। আবার ধর্মের স্রোতে যখন ভাঁটা আসে, তখন মনে হয়, এই বিশ্ব লাগামহীন, কর্তৃত্বহীন অবস্থায় আপনাআপনি যন্ত্রের মত চলিতেছে, সৃষ্টিকর্তা বা মালিকের ভূমিকা তখন ততটা দৃষ্টিগোচর হয় না।