৭৪৪

এই আয়াতে “যে পুরুষ চোর” এই কথাটি, “যে নারী চোর” কথাটির পূর্বে বলা হইয়াছে, ইহার কারণ পুরুষেরাই সাধারণতঃ চুরি করে বেশী, মেয়ে চোর সংখ্যায় কম। আবার ২৪ঃ৩ আয়াতে ব্যভিচারিণী উল্লেখ হইয়াছে “ব্যভিচারী”র পূর্বে। কারণ স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে, অবৈধ সঙ্গমের প্রমাণ মিলে সহজে, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে প্রমাণ তত সহজে মিলে না। তাছাড়া অধিক পর্দা করার আদেশ দেওয়া হইয়াছে স্ত্রীলোককে। স্ত্রীলোকের যথাযথ পর্দা না করার কারণেও অনেক সময় এই জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়, এই জন্যও ব্যভিচারিণীর উল্লেখ ব্যভিচারীর আগে করা হইয়াছে, বলা যায়। ইহাদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের কথাগুলি অতিশয় প্রজ্ঞার সহিত সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো হইয়াছে। এমনকি শব্দ-সাজানোর মধ্যেও বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলা এবং বিন্যাস রহিয়াছে। চুরি করার যে শাস্তি নির্ধারণ করা হইয়াছে, তাহা খুবই কঠোর বলিয়া মনে হয়। তবে, মানুষের অভিজ্ঞতা হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, অপরাধ নিবারণ করিতে হইলে শাস্তি দৃষ্টান্ত মূলক হওয়া প্রয়োজন। সহস্র জনকে কুপথ হইতে বাঁচাইতে গিয়া একজনের প্রতি কঠোর হওয়া ভাল, কিন্তু একজনকে প্রশ্রয় দিয়া হাজারো জনকে নষ্ট করা কোন মতেই ঠিক নহে। যে সার্জন পচনশীল অঙ্গকে কাটিয়া ফেলিয়া দেন, তিনিই ভাল সার্জন, কেননা তিনি বাকী সমস্ত শরীরটাকে বাঁচাইলেন। ইসলামের পূর্ণ বিকাশের দিনে চোরের হাত কাটার ঘটনা বড় একটা ঘটে নাই বলিলেই চলে। কারণ, এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছিল কার্যকর প্রতিরোধক। আরব দেশে, যেখানে এই শাস্তিদান এখনও বলবৎ আছে, চুরির ঘটনা কদাচিত ঘটিয়া থাকে। এই শাস্তির প্রকৃত স্বরূপ বুঝার জন্য, কাতউ’ ‘ইয়াদ’ (কর্তন ও হাত) দুইটি শব্দের আক্ষরিক ও রূপক অর্থ জানা দরকার। আরবীতে কাতাআ’হু বিল হুজ্জাত’ অর্থ সে যুক্তিদ্বারা তাহাকে নীরব করিয়া দিল’ (লেইন)। ‘ইয়াদ’এর অন্যান্য অর্থ ছাড়াও একটি অর্থকর্মক্ষমতা বুঝায়। যেমন, ‘কাতাআ’ ইয়াদাহু’ রূপক অর্থে বুঝায়, তাহাকে কাজ করিবার ক্ষমতা-রহিত করা হইল বা তাহাকে কাজ করা হইতে বিরত বা সংযত করা হইল৷ ১২ঃ৩২ দেখুন। শব্দ দুইটির এই তাৎপর্য অনুযায়ী, এই আয়াতে ফাকতায়ু’আইদিয়াহুমার অর্থ এইরূপ হইতে পারে, তাহাদের চুরি করিবার ক্ষমতা হরণ কর অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা গ্রহণ কর যাহাতে তাহারা চুরি করিতে না পারে। আক্ষরিক অর্থ নিলে, এই আয়াতে যে শাস্তির কথা বলা হইয়াছে, তাহা সবোচ্চ শাস্তি। আর শাস্তি সেই পাকা চোরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, চুরি করা যাহার স্বভাবের অঙ্গ হইয়া গিয়াছে। আর নিম্নতর শাস্তি হইল, এমন উপায় অলম্বন করা যাহাতে অপরাধী ব্যক্তি চুরি করার ক্ষমতা হইতে বিরত ও নিবৃত্ত থাকে। শাস্তি-দানের সময়, কার্য-কারণ ও অবস্থা-ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়াদিও বিবেচনা করিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত, ‘আস্-সারিক’ শব্দের মধ্যে আতিশয্যের ভাব বিদ্যমান থাকায় সাধারণ চোর না বুঝাইয়া বরং স্বভাব চোর বা “পাকা চোর’ বুঝাইতেছে, এই কথা বিবেচনায় রাখিতে হইবে। কি পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি চুরি করিলে এই হাত কাটার শাস্তি প্রযোজ্য হইবে, এই নিয়াও জ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, তিন দিরহাম বা সিকি দীনার চুরি করিলে এই শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে। কেহ কেহ বলেন, গাছ হইতে ফল পাড়িলে, কিংবা ভ্রমণরত অবস্থায় চুরি করিলে এই শাস্তি দেওয়া যাইবে না (দাউদ)। ইমাম আবু হানিফা ১০ দিরহাম, ইমাম মালিক ও ইমাম শাফী ৩ দিরহাম চুরি করা, এই শাস্তির জন্য নূ্যনতম সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ করিয়াছেন। ধর্ম বিশারদগণের মতানৈক্য ইহাই প্রমাণ করে যে, শাস্তি দানের ব্যাপারে ইহার প্রকৃতি, ধরণ ও পরিমাণাদি নির্ণয়ে বিচারক বহুলাংশে স্বীয় বুদ্ধি-বিবেচনা খাটাইতে পারেন।