৬৯৯

“মা কাতালুহু একীনান” বাক্যটির অর্থঃ (১) তাহারা নিশ্চয় তাহাকে হত্যা করিতে পারে নাই, (২) তাহারা তাহার (ঈসা আঃ-এর) মৃত্যুর অনুমানকে নিশ্চয়তার পর্যায়ে পৌছাইতে পারে না। অর্থাৎ ঈসা (আঃ)- এর ক্রুশে মৃত্যু সম্বন্ধীয় তাহাদের ধারণা সংশয়াতীত হইয়া তাহদের মনে নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে নাই। এই ক্ষেত্রে, ‘কাতালুহু’র ‘হু’ ‘যান্ন্‌’ (অনুমান) শব্দের সর্বনামরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে মনে করিতে হইবে। আরবেরা বলে, ‘কাতালাশ্ শাইয়া খুবরান’ অর্থাৎ সে বিষয়টি সম্বন্ধে এত জ্ঞান লাভ করিয়াছিল যে, ঐ বিষয়ে তাহার সংশয়ের সামান্য সম্ভাবনাও অবশিষ্ট রহিল না (লেইন, লিসান, এবং মুফরাদাত)। ঈসা (আঃ) যে ক্রুশে মৃত্যুবরণ না করিয়া পরে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন, তাহা কুরআন হইতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। বাইবেলের নিম্নবর্ণিত কথাগুলি হইতেও কুরআনের বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায়ঃ (ক) ঈসা (আঃ) আল্লাহ্‌র প্রেরিত পুরুষ ছিলেন। তাঁহার পূণ্যজীবনের অবসান ক্রুশের উপরে কখনই হইতে পারে না। কারণ বাইবেল অনুযায়ী, “যে ব্যক্তি ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে সে আল্লাহ্‌র অভিশাপ গ্রস্ত (দ্বিতীয়-২১ঃ২৩)। (খ) তিনি অতিশয় কাতর হৃদয়ে রাতভর দোয়া করিয়াছিলেন, “আমার নিকট হইতে এই পান পাত্র দূর কর” (মার্ক-১৪ঃ৩৬; মথি-২৬ঃ৩৯, লুক-২২ঃ৪২) এবং তাঁহার এই দোয়া কবুল হইয়াছিল (হবঃ-৫ঃ৭) (গ) তিনি পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, ইউনূস নবী (আঃ) যেমন মাছের পেটে জীবিতাবস্থায় গিয়াছিলেন এবং জীবিত অবস্থায়ই উহার পেট হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিলেন (মথি-১২ঃ৪০), তেমনি তিনিও খোদিত কবরে তিন দিন থাকিয়া জীবিত অবস্থায়ই উহা হইতে বাহির হইয়া আসিবেন। (ঘ) তিনি ইহাও ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, ইস্‌রাঈলের দশটি হারানো গোত্রকে খুঁজিয়া পাওয়ার জন্য তাঁহাকে বাহিরে যাইতে হইবে (যোহন-১০ঃ১৬)। ঈসা (আঃ)-এর সময়ের ইহুদীগণও বিশ্বাস করিত যে, ইস্‌রাঈলের হারানো গোত্রগুলি বিভিন্ন দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে (যোহন-৭ঃ৩৪,৩৫)। (ঙ) ঈসা (আঃ) মাত্র তিন ঘন্টার মত ক্রুশে লটকানো অবস্থায় ছিলেন (যোহন-১৯ঃ১৪) এবং তাঁহার মত স্বাভাবিক শারীরিক গঠনের ব্যক্তি এত অল্প সময়ে ক্রুশে মরিতে পারেন না। (চ) ক্রুশ হইতে নামাইবার পরে পরেই তাহার পার্শ্বদেশে ধারাল অস্ত্রের দ্বারা আঘাত করা হয় এবং রক্ত ও পানি সেই আহত স্থল হইতে ফিনকি দিয়া বাহির হইয়া আসে। ইহা তাঁহার জীবিত থাকার পরিচায়ক (যোহন-১৯ঃ৩৪)। (ছ) ইহুদীরা, ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর ব্যাপারে নিজেরাই নিশ্চিত ছিল না। কারণ তাহারা পীলাতকে তাঁহার কবরে পাহারাদার রাখার অনুরোধ জানাইয়াছিল। তাহারা এই বলিয়া অনুরোধ করিয়াছিল, “তাঁহার শিষ্যরা রাত্রে আসিয়া তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া যাইতে পারে এবং তৎপর জনগণের কাছে বলিতে পারে, তিনি মৃতের মধ্য হইতে, জীবিত হইয়া উঠিয়াছেন’ (মথি-২৭ঃ৬৪)। (জ) সুসমাচারগুলির একটিতেও কোন চাক্ষুস-সাক্ষীর বিবৃতি লিপিবদ্ধ নাই যে, তাহাকে ক্রুশ হইতে নামাইবার সময়ে তিনি মৃত অবস্থায় ছিলেন কিংবা কবরে রাখার সময়ে তিনি মৃত ছিলেন। তাছাড়া তাঁহাকে ক্রুশে চড়াইবার সময়, একজন অনুসারীও ঐ দৃশ্যপটে উপস্থিত ছিলেন না। তাহারা সকলেই আত্মগোপন করিয়াছিলেন। আসল ঘটনা এইরূপ ছিল যে, পীলাতের স্ত্রীর পূর্ববতী রাত্রের স্বপ্ন-বাণী, “এই ন্যায়বান ব্যক্তির ক্ষতি করিও না”, পীলাতের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করিয়াছিল যে ঈসা (আঃ)নিরপরাধ। তাই পীলাত, ‘এসেনি’ফেরকার সম্মানিত ব্যক্তি আরিমেথিয়ার যোসেফের সাথে যুক্তি করিয়া ঈসা (আঃ)কে বাঁচাইবার কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন। কারণ, নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ঈসা (আঃ) এসেনি ফেরকারই সদস্য ছিলেন। ঈসা (আঃ)-এর বিচার হইয়াছিল শুক্রবারে। পীলাত বিচার-কার্য ইচ্ছাপূর্বক দীর্ঘায়িত করিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন যে, ক্রুশের শাস্তি-প্রাপ্ত ব্যক্তিদিগকে শুক্রবার দিবাগত সন্ধ্যায়ই ক্রুশ হইতে নামাইয়া ফেলিতে হইবে। তাই তিনি যখন ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ক্রুশের শাস্তি ঘোষণা করিতে বাধ্য হইলেন, তখন সূর্যাস্ত হইতে মাত্র তিন ঘন্টা বাকী ছিল, তিনি নিশ্চিত হইয়াছিলেন যে, সাধারণ স্বাস্থ্য-সম্পন্ন কোনও ব্যক্তিই এত অল্প সময় ক্রুশে থাকিয়া মৃত্যু বরণ করে না। পীলাত কিছু অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করিয়া, ঈসা (আঃ)- কে সুগন্ধি নির্যাস মিশ্রিত সিরকা জাতীয় পানীয় পান করাইয়াছিলেন যাহাতে তাহার কষ্টানুভূতি কম হয়। ক্রুশে লটকাইবার তিন ঘন্টা পরে, ঈসা (আঃ)-কে যখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নামানো হইল (সম্ভবতঃ সিরকার প্রভাবে অচেতন ছিলেন), তখন আরিমেথিয়ার যোসেফের অনুরোধে পীলাত সাথে সাথে ঈসা (আঃ)-এর দেহ তাহাকে সমর্পণ করিলেন। ঈসা (আঃ)-এর সাথে দুইজন দুষ্কৃতকারীকেও ক্রশে লটকানো হইয়াছিল এবং তাহাদের হাড় ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু ঈসা (আঃ)-এর হাড় ভাঙ্গা হয় নাই। যোসেফ পাহাড়ের টিলার গাত্রে খোদাই করা প্রশস্ত কোঠায় তাঁহার দেহটি রাখিলেন। তাঁহার দেহের কোনরূপ ডাক্তারী পরীক্ষা হয় নাই, জীবিত কি মৃত তাহাও পরীক্ষা করা হয় নাই, এমন কি এ ব্যাপারে তাঁহার অন্তিম সময়ের কাহারও সাক্ষ্য প্রমাণও নেওয়া হয় নাই (মিস্‌টিকেল লাইফ অব জিসাস, প্রণেতা এইচ, স্পেন্সার লিউইস)। (ঝ) একটি ভেষজ মলম (ইহা পরে ‘মরহমে ঈসা’ বা ঈসার মলম নামে পরিচিত হয়) তৈরী করিয়া তাঁহার ক্ষতস্থানগুলিতে প্রলেপ দেওয়া হয় এবং আরিমেথিয়ার যোসেফ ও নিকোডিমাস তাঁহার শুশ্রুষা ও সেবাযত্ন করিতে থাকেন। ‘নিকোডিমাস এসেনি’ ভ্রাতৃমণ্ডলীর একজন অতি সম্মানী ও উচ্চ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। (ঞ) ঈসা (আঃ)-এর ক্ষতগুলি মোটামুটি সারিয়া উঠিলে, তিনি কবরটি ত্যাগ করেন এবং রাত্রিযোগে পর পর কয়েকজন শিষ্যের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাহাদের সাথে খাদ্য গ্রহণ করেন। অতঃপর, তিনি পদব্রজে জেরুসালেম হইতে গেলিলী চলিয়া যান (লুক-২৪ঃ৫০)। (টা) আমেরিকায় প্রথমে ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে ’দি ক্রুসিফিকশন বাই এন আই-উইটনেস’ নামক একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। ক্রুশের ঘটনার সাত বৎসর পর, জেরুযালেমের এসেনি ভ্রাতৃত্ব-মণ্ডলীর একজন সদস্য আলেকজান্দ্রিয়ার অপর এসেনি ভ্রাতা সদস্যকে এই বিষয়ের উপর একটি পত্র লিখিয়াছিলেন। পত্রটির পুরাতন ল্যাটিন ভাষার কপির ইংরেজী অনুবাদ করিয়া, উক্ত পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকট, এই অভিমতের জোরালো সমর্থন যোগাইয়াছে যে, ঈসা (আঃ) ত্রুশ হইতে অবতরণের পর জীবিত ছিলেন। পুস্তকখানা, ক্রুশে-লটকানোর পূর্ব-ঘটনাবলীর বিবরণ, ক্রুশ-স্থলের দৃশ্যাবলী এবং পরবর্তী ঘটনা সমূহ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছে। (তফসীরের বৃহত্তর ইংরেজি বা উর্দু সংস্করণও দেখুন)। ঈসা (আঃ)-এর তথাকথিত ক্রুশবিদ্ধ-মৃত্যু সম্বন্ধে ইহুদীদের মধ্যে দুইটি পৃথক মতামত রহিয়াছে। একদল বলে যে, তাঁহাকে প্রথমে মারা হইয়াছিল এবং পরে তাঁহার মৃতদেহ ক্রশে লটকানো হইয়াছিল। অন্যেরা বলে, ক্রুশে লটকাইয়াই তাঁহাকে হত্যা করা হইয়াছে। প্রথমোক্ত মতটি প্রেরিত-৫ঃ৩০ এর উপর ভিত্তি করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, সেখানে লেখা আছে, “যাহা তোমরা বধ করিয়াছিলে এবং গাছে লটকাইয়াছিলে।” কুরআন এই দুইটি অভিমতকেই খণ্ডন করিয়া বলিতেছে, তাহারা তাঁহাকে হত্যা করিতে পারে নাই, এমন কি ক্রুশে লটকাইয়াও হত্যা করিতে পারে নাই।” প্রথমে কুরআন বলিতেছে, তাহারা বহু রকমের চেষ্টা করিয়া কোনও প্রকারেই তাঁহাকে হত্যা করিতে পারে নাই, অতঃপর বলিতেছে শেষ পর্যন্ত তাহারা ষড়যন্ত্র করিয়া তাঁহাকে ক্রুশে লটকাইল, কিন্তু তাহাতেও তাঁহাকে মারিতে পারিল না। কুরআন ঈসা (আঃ)-কে ক্রুশে লটকানোর কথা অস্বীকার করে নাই। বরং ক্রুশের উপরেই ঈসা (আঃ) মরিয়াছেন, এই কথাটি অস্বীকার করে।