৬৬

‘ইব্‌লীস্‌’ শব্দটি আবলাসা হইতে উৎপন্ন, যাহার ধাতুগত অর্থ (১) তাহার গুণ কমিল; (২) সে নিরাশ হইল বা আল্লাহ্‌র রহমতের আশা ছাড়িয়া দিল; (৩) সে তাহার আশা-পূরণে বাধা-প্রাপ্ত হইল; (৪) সে হতোদ্যম হইল, (৫) সে হতভম্ব হইয়া রাস্তা দেখিতে পাইল না। এই ধাতুগত অর্থগুলি হইতে বুঝা যায়, ইবলীস এমনই এক সত্তা যাহার মধ্যে ভালোর মাত্রা অতি অল্প এবং মন্দের মাত্রা অনেক বেশী রহিয়াছে। নিজের অবাধ্যতার কারণে, আল্লাহ্‌র রহমতের আশা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিয়াছে এবং হতভম্ব ও কিংকর্তব্য-বিমূঢ় অবস্থায় পথ পাইতেছে না। ইব্‌লীসকে প্রায়শঃ শয়তান মনে করা হয়, তবে সময় সময় কিছু কিছু বিষয়ে এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্যও দেখা যায়। এই কথা স্পষ্ট বুঝিয়া রাখা দরকার যে, ইব্‌লীস ফিরিশ্‌তাদের অন্তর্গত নহে। কেননা ইব্‌লীসকে বর্ণনা করা হইয়াছে আল্লাহ্‌তা’লার আদেশ অমান্যকারী বিদ্রোহী রূপে। অপর পক্ষে ফিরিশ্‌তাকে বর্ণনা করা হইয়াছে চির-অবনত, বিনীত ও আজ্ঞাবহ রূপে (৬৬ঃ৭)। ইব্‌লীসের প্রতি আল্লাহ্ ক্রুদ্ধ হইলেন, কেননা ফিরিশ্‌তাদের মত তাহাকেও আদেশ করা হইয়াছিল—আদমকে মান্য করা ও সাহায্য করার জন্য কিন্তু সে তাহা অমান্য করিল (৭ঃ১৩)। অধিকন্তু, যদি ইবলীসকে পৃথকভাবে কোনও আদেশ নাও দেওয়া হইয়া থাকে, তথাপি ফিরিশ্‌তাদিগকে আদেশ দানের মধ্যবর্তিতায় তাহা সকলের উপরেই প্রযোজ্য হইয়া যায়। কেননা, বিশ্বজগতের বিভিন্ন অংশের রক্ষণাবেক্ষণকারী হওয়ার কারণে, ফিরিশ্‌তাদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অন্যান্য সকল বস্তু ও জীবের উপরও সমভাবে বর্তাইবে। ইব্‌লীস একটি গুণবাচক নাম। ফিরিশ্‌তাদের প্রতিপক্ষ ও বিরোধিতাকারী অশুভ চক্রকে, শব্দটির ধাতুগত অর্থেই, ইব্‌লীস নাম দেওয়া হইয়াছে। কুরআনে, ২ঃ৩৭ আয়াতে যে শয়তানের কথা বলা হইয়াছে, সে যে ইব্‌লীস নহে, তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠে যখন আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআনে যেখানেই আমরা আদমের বিষয়ে বর্ণিত হইতে দেখি,তখনই ইব্‌লীস ও শয়তানের দুইটি নাম পাশা পাশি প্রাপ্ত হই। কিন্তু প্রত্যেক স্থানেই আমরা এতদুভয়ের মধ্যে একটা সতর্ক পার্থক্য লক্ষ্য করি। যেখানেই আমরা ফিরিশ্‌তার বিপরীত মুখী, আদমের আনুগত্য করিতে অস্বীকারকারী সত্তার উল্লেখ পাই, সেখানেই তাহাকে ইব্‌লীস নামে আখ্যায়িত হইতে দেখি। আর যেখানেই আমরা আদমের বিরুদ্ধে প্রতারণাকারী ও তাহাকে উদ্যান হইতে বিতাড়নের চক্রান্তকারী সত্তার উল্লেখ দেখি, সেখানেই তাহাকে শয়তান নামে অভিহিত পাই। এই পার্থক্য যাহা কমপক্ষে কুরআনের দশটি স্থানে মওজুদ আছে, (২ঃ৩৫,৩৭, ৭ঃ১২,২১, ১৫ঃ৩২, ১৭ঃ৬২, ১৮ঃ৫১, ২০ঃ১১৭, ১২১, ৩৮ঃ৭৫), তাহা অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ। ইহাতে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, ইব্‌লীস ও শয়তান এক নহে।

শয়তান আদমের প্রতারণাকারী। ইব্‌লিস আদমের জাতিরই অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের অন্যত্র বলা হইয়াছে, ‘ইব্‌লীস আল্লাহ্‌র গুপ্ত সৃষ্টির(জিন্নের) অন্তর্ভুক্ত এবং ফিরিশ্‌তার বিপরীতে আল্লাহ্‌র বাধ্যতা বা অবাধ্যতা করার সামর্থ্য রাখে (৭ঃ১২-১৩, ১৮ঃ৫১)।