৬১

হযরত আদম (আঃ), যিনি প্রায় ছয় হাজার বৎসর পূর্বে পৃথিবীতে বাস করিয়াছিলেন, সাধারণভাবে তাহাকেই আল্লাহ্‌র সৃষ্ট প্রথম মানব বলিয়া বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু কুরআন এই মতবাদ সমর্থন করে না। এই বিশ্ব, সৃষ্টি ও সভ্যতার বিভিন্ন চক্র বা বলয় অতিক্রম করিয়াছে। বর্তমান মানব জাতির পূর্বপুরুষ আদম চলতি বলয়ের প্রথম সংযোগ কড়া। তিনি আল্লাহ্‌র সৃষ্টির মধ্যে একেবারে আদিমানব নহেন, বরং তিনি বর্তমান বলয়ের প্রথম সভ্য মানব, যাহার মাধ্যমে নূতন বলয়ের নব-সভ্যতার ক্রম-বিকাশের নব-ধারা প্রবর্তন করা হইয়াছে। বহু জাতির উত্থান-পতন হইয়াছে। অনেক সভ্যতার আগমন নির্গমন ঘটিয়াছে। আমাদের পিতৃপুরুষ আদমের পূর্বে সভ্যতার পত্তনকারী অন্যান্য আদমও আসিয়াছেন। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠিরও উদ্ভব ও বিনাশ ঘটিয়াছে, অন্যান্য সভ্যতার চক্রও আমাদের আদমের পূর্বেই আসিয়াছে ও গত হইয়াছে। মুসলিম বিশ্বের সুফীকুল শিরোমণি হযরত মুহীউদ্দিন ইবনে আরাবী বলেন যে, তিনি একবার স্বপ্ন দেখিলেন, তিনি কা’বা শরীফের তাওয়াফ করিতেছেন। স্বপ্নের মধ্যেই একজন লোক তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দেখা দিলেন এবং নিজেকে তাহার পূর্ব-পুরুষ বলিয়া পরিচয় দিলেন। ইবনে আরাবী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার মৃত্যু কবে হইয়াছিল”? লোকটি উত্তরে বলিলেন, “চল্লিশ হাজার বৎসরেরও বেশী হইবে, আমার মৃত্যু হইয়াছে।” ইবনে আরাবী বলিলেন, “আদম (আঃ) হইতে আমাদের বর্তমান কাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হইয়াছে, এই দীর্ঘ সময় ত তাহার চাইতেও অনেক বেশী”। ঐ ব্যক্তি বলিলেন, “তুমি কোন আদমের কথা বলিতেছ? তোমাদের সর্বনিকটবর্তী আদমের কথা, না অন্য কোন আদমের কথা?” ইবনে আরাবী বলিতেছেন, তখন রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর একটি হাদীস তাহার মনে পড়িল, যাহার মর্ম হইল, “আল্লাহ্ এক লক্ষেরও বেশী আদমকে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন।” তখন ইবনে আরাবী নিজে নিজে বলিলেন, “এই ব্যক্তি যিনি আমার পূর্বপুরুষ হইবার দাবী করিতেছেন, তিনি নিশ্চয় পূর্ববর্তী আদমগণের অন্তর্ভুক্ত হইবেন” (ফুতুহাতে মক্কীয়া, ২য় খণ্ড)। এই কথা দাবী করা হইতেছেন যে, আদম (আঃ)-এর পূর্বে যে মানবগোষ্ঠী পৃথিবীতে বসবাস করিতেছিল, তাহারা সম্পূর্ণরূপে বিনাশ প্রাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। সম্ভবতঃ তাহাদের মধ্যে হইতে কিছু লোক অতি হীন অবস্থায় টিকিয়া ছিল, যাহাদের মধ্যে আদমও একজন ছিলেন। সেই অবস্থায়, আল্লাহ্‌তা’লা তাঁহাকে একটি নূতন মানব-গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ ও একটি নূতন সভ্যতার পত্তনকারী-নবীরূপে নির্বাচন করিলেন। এই হিসাবেই তিনি এক নব জীবনের সূচনাকারী রূপে পরিগণিত হইলেন। যেহেতু খলীফা শব্দের অর্থ উত্তরাধিকারী, সেই হেতু ইহা স্পষ্টতঃ বুঝা যায় যে, আদমের পূর্বেও মানুষ ছিল এবং তিনি তাহাদের উত্তরাধিকারী হইলেন। আমাদের পক্ষে বলা কঠিন, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা এই আদমের বংশধর না পূর্ববর্তী কোন আদমের বংশধর।

আদম কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং কোথায় তাহাকে সংস্কারকরূপে অধিষ্ঠিত করা হইয়াছিল, ইত্যাদি ব্যাপারে অনেক কথাই বলা হইয়াছে। সাধারণ বিশ্বাস ইহাই যে, তাঁহাকে বেহেশ্‌তে রাখা হইয়াছিল এবং পরে তাঁহাকে সেখান হইতে বিতাড়িত করিয়া পৃথিবীতে কোথাও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। কিন্তু “পৃথিবীতে খলীফা নিয়োগ” শব্দগুলি এই অভিমতকে সরাসরি খণ্ডন করে এবং সুস্পষ্টভাবে বলিয়া দেয় যে, আদম পৃথিবীতে বসবাস করিয়াছিলেন এবং পৃথিবীর মধ্যেই সংস্কার কার্যে তাহাকে নিয়োগ করা হইয়াছিল। খুব সম্ভব, প্রথমে তাঁহার বসবাস ছিল ইরাকে, পরে প্রতিবেশী কোনও অঞ্চলে যাইবার জন্য তিনি আল্লাহ্‌তা’লার নির্দেশ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই আয়াতের আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য উর্দু বা ইংরেজী তফসীরে কবীর দেখুন।