৫৬০

এই আয়াতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—কারণ ইহাতে বিশেষ বিশেষ অবস্থায়, বহু বিবাহের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। ইসলাম একজন পুরুষকে একাধিক স্ত্রী, সর্বাধিক চারিজন স্ত্রী, রাখার অনুমতি দান করিয়াছে। তবে, ইহার জন্য কোন তাকিদ বা উৎসাহ প্রদান করে নাই। যেহেতু, এতীমদের বিষয় উল্লেখ করিতে যাইয়া, এই বহু বিবাহের কথাটি আসিয়াছে, সেই হেতু প্রাথমিক ভাবে ইহাই বুঝা সমূচিত হইবে যে, সমাজের সর্বাপেক্ষা অবহেলিত পিতা-মাতাহীন দুঃখীদিগকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করিবার মানসে এই একাধিক বিবাহের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এতীম মেয়েদের মধ্য হইতে এক বা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার মাধ্যমেই তাহাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায় এবং বিশেষ বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য স্ত্রীলোক হইতেও এক বা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করিয়া সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বহু বিবাহ বিষয়টি যদিও এতীমদের কথা বলিতে গিয়া আসিয়াছে, তথাপি এমন অনেক পরিস্থিতিরও উদ্ভব হইতে পারে, যখন সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু বিবাহ রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করিতে পারে। কেবল মাত্র বিবাহের উদ্দেশ্যের প্রতি যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি, তাহা হইলেই আমরা দেখিতে পাইব যে, বহু বিবাহের এই অনুমতি যে শুধু ন্যায়-সঙ্গত তাহাই নহে, বরং অতীব বাঞ্ছনীয় ও প্রয়োজনীয়। এমন কি, ক্ষেত্র বিশেষে এই অনুমতির সদ্ব্যবহার না করিলে, ব্যক্তির ও সমাজের সর্বোচ্চ স্বার্থের ক্ষতি হইতে পারে। কুরআনের মতে বিবাহের উদ্দেশ্য চারিটিঃ (১) শারীরিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধি (অবনতি) হইতে বাঁচিয়া থাকা (২ঃ১৮৮, ৪ঃ২৫), (২) মনের প্রশান্তি ও ভালবাসাপূর্ণ সাথী লাভ করা (৩০ঃ২২), (৩) সন্তানাদি লাভ এবং (৪) আত্মীয়তার পরিধি বৃদ্ধি করা (৪ঃ২)। উপরোক্ত উদ্দেশ্যাবলীর একটি বা সবটি উদ্দেশ্য একটি বিবাহের মাধ্যমে, সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, এক ব্যক্তির স্ত্রী যদি স্থায়ীভাবে অক্ষম বা পঙ্গু হইয়া যায় কিংবা কোনও দূরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তির বিবাহোদ্দেশ্য বিফল হইয়া যাইবে, যদি সে অন্য মহিলাকে বিবাহ না করে। বস্তুতঃ একটি বৈধ বিবাহ করা ছাড়া তাহার কোন গত্যন্তর থাকে না। অন্যথায়, তাহার স্বাভাবিক কামনা চরিতার্থ করার জন্য, সে গর্হিত কাজে লিপ্ত হইবে, যদি সেই ব্যক্তি কামনা-বাসনার তাড়নাকে প্রতিহত করার মত শক্তি না রাখে। তাছাড়া, একজন রুগ্ন স্ত্রী কখনও ভাল সঙ্গিনী হইতে পারে না। যদিও ঐ স্ত্রী সর্বতোভাবে সম্মান ও সহানুভূতির যোগ্য, তথাপি তাহার সঙ্গ স্বামীর মনকে সবদিক দিয়া শান্তি দিতে পারে না। তেমনিভাবে,যদি একমাত্র স্ত্রী বন্ধ্যা হয়,তাহা হইলেও স্বামীর ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক সন্তান প্রাপ্তির স্বাভাবিক বাসনা অচরিতার্থ থাকিয়া যাইবে, যদি সে অন্য বিবাহ না করে। এই সব সম্ভাব্য অবস্থাদি মোকাবিলা ও সমাধান করার জন্য ইসলাম একাধিক বিবাহের অনুমতি দান করিয়াছে। উপরোক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হইলেই যদি স্বামী প্রথমা স্ত্রীকে তালাক দিয়া পরিত্যাগ করে, তাহা হইলে ইহা হইবে পুরুষের জন্য লজ্জা ও অপমানের কাজ। প্রকৃত পক্ষে, এক বিবাহ ও বহু বিবাহ উভয়ই উদ্দেশ্যের দিক হইতে প্রায় এক যখন একটি উদ্দেশ্য কিংবা সবগুলি উদ্দেশ্য এক বিবাহে অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তখন বহু বিবাহ প্রয়োজনীয় হইয়া পড়ে। এতদ্ব্যতীত, কোন কোন সময় অন্যান্য কারণে স্বামীর একমাত্র স্ত্রী সব উদ্দেশ্য পূর্ণ করা সত্বেও এবং স্বামী তাহাকে মনে প্রাণে ভালবাসা সত্বেও, স্বামীর বহু বিবাহ করা একান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িতে পারে। এই কারণগুলি হইতেছেঃ (১) এতীমের রক্ষা, (২) বিবাহযোগ্যা বিধবাগণের স্বামী-প্রাপ্তি এবং (৩) কোন পরিবারের বা সম্প্রদায়ের হ্রাস প্রাপ্ত জন-সংখ্যার বৃদ্ধি সাধন। অত্র আয়াত হইতে ইহা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, অরক্ষিত এতীমগণের রক্ষণাবেক্ষণের বিশেষ উদ্দেশ্যে বহু-বিবাহ প্রথার আশ্রয় নেওয়া যাইতে পারে। আয়াতটির নিগূঢ় উদ্দেশ্য হইলঃ কোন পিতৃহীন শিশুর উপর যে ব্যক্তির অভিভাবকত্ব বর্তাইবে, ঐ শিশুর মাকে ঐব্যক্তির পক্ষে বিবাহ করিয়া ফেলাই শ্রেয়ঃ, এভাবে সাক্ষাৎ সম্পর্কের মাধ্যমে সে অধিকতর নিকটবর্তী হইয়া, তাহাদের মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়, যাহা অন্যভাবে সম্ভব নয়। বিধবার জন্য স্বামী-প্রাপ্তির ব্যবস্থা (২৪ঃ৩৩) বহু-বিবাহের অপর উদ্দেশ্য। মুসলমানেরা নবী করীম (সাঃ)-এর সময় ক্রমাগতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। অনেকেই এইসব যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁহারা অনেকেই স্ত্রী ও সন্তানগণকে অসহায় অবস্থায় রাখিয়া যান। যুদ্ধের ফলে পুরুষের সংখ্যা হইতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অসহায় এতীমদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়া যাওয়ায়, মুসলিম সমাজকে নৈতিক অধঃপতনের হাত হইতে বাঁচানোর তাকিদে, বহু-বিবাহের প্রয়োজন ছিল। গত দুইটি মহাযুদ্ধ ইসলামের এই কার্যকরী বহু বিবাহের যথার্থতা প্রমাণ করিয়াছে। এই বিশ্বযুদ্ধ দুইটি বহু যুবতী মহিলাকে বিধবা করিয়া ছাড়িয়াছে। এই দুইটি যুদ্ধের ফলে অসংখ্য পুরুষের জীবন হানি ঘটায়, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে মেয়েদের সংখ্যা পুরুষের সংখ্যার তুলনায় অত্যাধিক হইয়া পড়ে। আর এই কারনেই পশ্চিমা সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এমনভাবে বিস্তার লাভ করিয়াছে যে, তাহাদের সামাজিক জীবনে এক বিভীষিকাময় অস্থিরতা নামিয়া আসিয়াছে। যুবতী বিধবার স্বামীর ব্যবস্থা করা ছাড়াও যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে যখন সমাজে পুরুষ ও পৌরুষের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে এবং জনশক্তি ও শ্রম-শক্তি নিঃশেষিত হইয়া জাতির ধ্বংসের উপক্রম হয়,তখন এই বহু বিবাহ প্রথার সদ্ব্যবহার দ্বারা এইরূপ ভয়ঙ্কর অবস্থা হইতে জাতি রক্ষা পাইতে পারে। কোনও জন-গোষ্ঠীর জন্মহার যখন কোন কারণে লক্ষ্যণীয় ভাবে পড়িয়া গিয়া জনসংখ্যা কেবল কমিতেই থাকে, তখন সেই জন-গোষ্ঠীকে বাঁচাইবার একমাত্র অবলম্বন বহু বিবাহ। ভ্রমবশতঃ কেহ কেহ ইহাই মনে করিয়া থাকেন যে, বহু বিবাহ জৈবিক কামনা মিটাইবার একটা উপায় মাত্র। এই ধারণা ঠিক নয়। বরং বহু বিবাহের মধ্যে আত্মত্যাগের মনোভাব কাজ করে। বহু বিবাহ ব্যবস্থা পুরুষ ও স্ত্রীলোক উভয়ের ত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত ও সাময়িক আবেগগুলিকে জাতির ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি দিয়াই একাধিক বিবাহের পদক্ষেপ নিতে হয়।