‘মুহার্রার’ মানে মুক্তি-প্রাপ্ত, যে সন্তানকে পার্থিব কাজকর্ম হইতে মুক্ত করিয়া, পিতামাতা উপাসনালয়ের সেবার জন্য উৎসর্গ করিয়া দেন (লেইন ও মুফরাদাত)। বনী-ইস্রাঈলদের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে, যে সব সন্তানকে ধর্মশালার সেবায় উৎসর্গ করা হইত, তাহারা চিরকুমার বা চিরকুমারী থাকিত (গসপেল অব মেরী ৫ঃ৬ এবং তফসীরে বায়ান – ৩ঃ৩৬)। এই আয়াতে মরিয়মের মাতা হান্নাকে (এনসাই, বিব্) ‘ইমরাআতু ইম্রান’ (ইম্রানের স্ত্রী) বলা হইয়াছে। অনত্র ১৯ঃ২৯ আয়াতে মরিয়মকে ‘উখ্তে হারূণ’ (হারূনের বোন) বলা হইয়াছে। ইমরান (আম্রান) ছিলেন মূসা (আঃ) এবং হারূন (আঃ) এর পিতা। মরিয়ম নামে, মূসা ও হারূনের (আঃ) একজন বোন ছিলেন। কুরআনের বাকধারা ও সাহিত্য রীতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ খৃষ্টান লেখকগণ, যাহারা কুরআনকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রণীত গ্রন্থ বলিয়া মনে করে, এই ভুল ধরিয়া বেড়ায় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) অজ্ঞানতাবশতঃ মূসার ভগ্নী মরিয়মের সহিত যীশুর মাতা মরিয়মকে একাকার করিয়া ফেলিয়াছেন। এই সব বলিয়া, তাহারা মনে করে যে, কুরআনে তাহারা ঐতিহাসিক ভুল তথ্য আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। অথচ কুরআনে বহু আয়াত হইতে দেখা যায় যে, মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) এই দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়ে বহু নবী আগমন করিয়াছেন, সময়ের দিক দিয়া এই দুই নবীর দূরত্ব ও ব্যবধান খুবই দীর্ঘ (২ঃ৮৮, ৫ঃ৪৫)। বর্ণিত আছে যে, আঁ-হযরত (সাঃ) যখন মুগীরাকে (রাঃ) নাজ্রানের খৃষ্টানদের কাছে পাঠাইয়াছিলেন, তখন খৃষ্টানেরা তাহাকে প্রশ্ন করিল, “তুমি কি কুরআনে পড় নাই যে, সেখানে মরিয়মকে হারূণের ভগ্নী বলিয়া উল্লেখ রহিয়াছে, অথচ তুমি আমি সবাই জানি যে, হযরত মূসার কত সুদীর্ঘ সময় পরে যীশুর জন্ম হইয়াছিল?” মুগীরা বলেন, “আমি উত্তর জানিতাম না, তাই মদীনায় ফিরিয়াই আমি ইহা রসূলে করীম (সাঃ)-এর গোচরীভূত করি”। তিনি বলিলেন, “তুমি তাহাদিগকে এই কথা বলিলেই পারিতে যে, বনী ইস্রাঈলেরা প্রথা-অনুসারে তাহাদের সন্তানদের নাম হামেশাই নবীদের বা সাধুদের নামানুসারে রাখিয়া আসিয়াছে (অর্থাৎ একই নামে বহু ব্যক্তিকে পাওয়া যায়) (তিরমিযি)। প্রকৃত পক্ষে, এই বিষয়ে হাদীস রহিয়াছে যে, হান্নার স্বামী এবং সেই হিসাবে মরিয়মের পিতা ইম্রান নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁহার পিতার নাম ছিল যশ্হীম বা যশীম (জরীর এবং কাসীর)। অতএব, এই ‘ইমরান’ (মরিয়মের পিতা), মূসা (আঃ)-এর পিতা ‘ইমরান’ হইতে পৃথক। শেষোক্ত ইমরানের পিতা ছিলেন কোহাথ (যাত্রা পুস্তক- ৬ঃ১৮-২০)। খৃষ্টান ধর্ম গ্রন্থে হান্নার স্বামী অর্থাৎ মরিয়মের পিতার নাম ‘যোয়চিম’ বলিয়া উল্লেখিত হওয়াতে (গসপেল অব বার্থ অব মেরী এবং এনসাই, ব্লুটু মেরী শীর্ষক) বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ নাই। ইবনে জরীর ইম্রানের পিতা রূপে যে যশীমের নাম উল্লেখ করিয়াছেন তিনি ঐ যোয়াচিম বই আর কেহ নন। খৃষ্টান সাহিত্যের ইহা এক সাধারণ রীতি যে দাদাকে পিতার স্থলে উল্লেখ করা হয়। তাহা ছাড়াও, বাইবেলে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে একই ব্যক্তির দুইটি পৃথক নাম দৃষ্ট হয়। যেমন গিডিওন কে বলা হয় জেরুব্বাল (বিচারক-৭ঃ১)। অতএব, ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই, যদি যোয়াচিম ও ইমরান একই ব্যক্তির দুই নাম হয়। তদুপরি, কেবল ব্যক্তিই নহে, বরং সময় সময় সারা পরিবারই প্রসিদ্ধ পূর্বপুরুষের নামে পরিচিত হইতে দেখা যায়। বাইবেলে ইস্রাঈল নামটি সময় সময় ইস্রাঈল জাতির জন্য ব্যবহৃত হয় (দ্বিতীয় বিবরণ-৬ঃ৩,৪) কেদার নামটি ইস্মাঈলের বংশধর সবাইকে বুঝাইয়া থাকে (যিশাইয়- ২১ঃ১৬, ৪২ঃ১১)। একই ভাবে, যীশুকে দাউদের পুত্র বলা হইয়াছে (মথি-১ঃ১)। অতএব, ‘ইমরায়াতু ইমরান’ দ্বারা, ইমরায়তু আ ল-ইমরান অর্থাৎ ইম্রান পরিবারের বা বংশের নারী বুঝাইতেও বাধা নাই। এই ব্যাখ্যা আরো শক্তিশালী হইয়া উঠে, যখন আমরা মাত্র দুই আয়াত পূর্বে কুরআনে আ ল-ইমরান (ইমরানের পরিবার) শব্দগুলি ব্যবহাত হইতে দেখিয়াছি। ‘আ ল’ (পরিবার) শব্দটি এখানে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে এই জন্য যে, মাত্র অল্প আগেই ইহা একবার ব্যবহার করা হইয়াছে; অতএব, এত কাছাকাছি ব্যবধানে আবার ব্যবহার না করিলেও অর্থ বুঝিতে কষ্ট হইবে না। এখানে স্বীকৃত বিষয় হিসাবে এই কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মরিয়মের মাতা হান্না, যিনি ইয়াহ্ইয়ার মাতা এলিজাবেথের চাচাত বোন ছিলেন, তিনি হারূনের বংশধর ছিলেন এবং সেই সূত্রে, ইমরানেরও বংশ ছিলেন (লুক- ১ঃ৫, ৩৬)। এই তফসীরের ইংরেজী বা উর্দু বৃহত্তর সংস্করণও দেখুন। এসেনিসদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়া মরিয়মের মাতা হান্না মরিয়মকে উপাসনালয়ের কাজে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। ঐ সময় এসেনিসরা সমকালীন মানুষের কাছে বড়ই সম্মানের পাত্র ছিলেন। কেননা, এসেনিস সম্প্রদায় সন্ন্যাসব্রত পালন ও স্ত্রীলোকের সংসর্গ ত্যাগ করিয়া, কেবল মাত্র ধর্মসেবা ও মানবসেবার কাজে নিজদিগকে উৎসর্গ করিতেন (এনসাই,বিব্, ও জিউ, এনসাই) ইহা প্রণিধান যোগ্য বিষয় যে, সুসমাচারের শিক্ষা এবং এসেনিসদের শিক্ষার মধ্যে অনেক মিল রহিয়াছে। ‘মুহাররার’ শব্দটির অর্থ হইতে ইহাও সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মরিয়মের মাতা তাহাকে উপাসনালয়ে উৎসর্গ করিবার মানত করা দ্বারা এই ইচ্ছাই পোষণ করিয়াছিলেন যে, মরিয়ম কখনও বিবাহ করিবে না এবং সন্ন্যাসিনী থাকিয়া যাজক শ্রেণীভুক্ত হইবে। আর এইজন্যই কুরআনের অন্যত্র মরিয়মকে হারূনের ভগ্নী বলা হইয়াছে, মূসার ভগ্নী বলা হয় নাই (১৯ঃ২৯)। অথচ হযরত মূসা ও হারূন সহোদর ভাই ছিলেন, এর কারণ এই যে মূসা (আঃ) ছিলেন ইহুদী জাতির শরীয়াতের বাহক ও প্রতিষ্ঠাতা নবী,আর হারূন ছিলেন সেই শরীয়াতের শিক্ষক, সেবক ও পুরোহিত, ইহুদী পৌরহিত্যের প্রথম কর্ণধার (এনসাই বিব্, এনসাই বৃট, হারূন অধ্যায়)। এই হিসাবেই মরিয়ম, যিনি পুরোহিতদের অন্তর্ভুক্ত হইবার জন্য উৎসর্গীকৃত ছিলেন, তিনি হারূনের ভগ্নী সাব্যস্ত হইলেন, সাধারণ সহোদরা অর্থে নহে।