৩৭৩

এই আয়াত দ্ব্যর্থ-বোধক কিংবা বিতর্ক-মূলক বিষয়ের মীমাংসার জন্য সুবর্ণ-নীতি বর্ণনা করিতেছে। এইরূপ ক্ষেত্রে উপদেশ হইল এই যে, বিষয়টিকে বা ব্যাখ্যাটিকে, কুরআনের পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত সমূহের আলোকে, পরীক্ষা ও বিবেচনা করিতে হইবে। যদি দেখা যায়, বিতর্কমূলক অর্থ বা ব্যাখ্যা, দ্ব্যর্থহীন আয়াতের বিপরীত বা বিরোধী হয়, তাহা হইলে বিতর্কমূলক বাক্যের বা বাক্যগুলির গঠন-পদ্ধতি সবদিক হইতে বিবেচনা করিয়া এমন অর্থ বা ব্যাখ্যায় পৌঁছাইতে হইবে, যাহা দ্ব্যর্থহীন আয়াতের সাথে খাপ খায়। এই আয়াত বলিতেছে, কুরআনে দুই ধরণের আয়াত রহিয়াছে। কতকগুলি রহিয়াছে ‘মুহকাম’ (দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অর্থ-বিশিষ্ট) এবং অন্যগুলি রহিয়াছে মুতাশাবিহ্ (যার বিভিন্ন অর্থ করা সম্ভব)। ‘মুতাশাবিহ্’ আয়াতের অর্থ সঠিক ভাবে পাওয়ার একটি সুন্দর পথ ইহাই রহিয়াছে যে, যতগুলি অর্থ হয়, উহার মধ্যে যেসব অর্থ ‘মুহকাম’ আয়াতের সাথে খাপ খায়, সেই অর্থই গ্রহণযোগ্য। ৩৯ঃ২৪ আয়াতে সমগ্র কুরআনকেই ‘মুতাশাবিহ্’ বলা হইয়াছে। আবার ১১ঃ২ আয়াতে সমগ্র কুরআনের আয়াতগুলিকেই ‘মুহ্‌কাম’ বলা হইয়াছে। ইহা দ্বারা এই বুঝায় না যে, আলোচ্য আয়াতটি উহার বিপরীত, কেননা আলোচ্য আয়াতে বলা হইয়াছে কতক আয়াত ‘মুহ্‌কাম’ ও কতক ‘মুতাশাবিহ্’। কুরআনের আয়াতগুলি, তাৎপর্যের দিক দিয়া দেখিলে সবই ‘মুহ্‌কাম’, কেননা সবগুলিতেই অপরিবর্তনীয় চিরসত্য রহিয়াছে। আবার অন্যদিক হইতে কুরআনের আয়াত সমূহ সবই মুতাশাবিহ্, কেননা কুরআনে এমনই ব্যাপক অর্থবোধক শব্দাবলী ব্যবহৃত হইয়াছে যাহা একই সময়ে অনেক অর্থ প্রকাশ করে, যাহা সমভাবে সত্য ও সুন্দর। কুরআন এই অর্থেও ‘মুতাশাবিহ্‌’ (পরস্পরের অনুরূপ) যে, ইহাতে কোন বৈপরীত্য বা অনৈক্য নাই, বরং ইহার আয়াতগুলি একে অপরের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ, সহায়তাকারী। তবে, হ্যাঁ, ইহার অংশ বিশেষ ‘মুহ্‌কাম’ ও অংশবিশেষ ‘মুতাশাবিহ্’, এই কথাও এইভাবে সত্য যে, বিভিন্ন পাঠকের জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মানসিকতা, প্রকৃতি-দত্ত শক্তির বিভিন্নতার কারণে, কুরআনকে বুঝিতেও বিভিন্নতা দেখা দেয়। এই আলোচ্য আয়াতে, এই দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কুরআনে যে সকল ভবিষ্যদ্বাণী রহিয়াছে, উহার মধ্যে যেগুলি সাদা-সিধা ও সরাসরি ব্যক্ত হইয়াছে, এবং যাহার একটি ভিন্ন দ্বিতীয় কোন অর্থ হইতে পারে না, সেইগুলিকে ‘মুহ্‌কাম’ বলা যাইতে পারে। অপর দিকে যে সকল ভবিষ্যদ্বাণী আলঙ্কারিক ও রূপক ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে, এবং যে গুলির ব্যাখ্যা একাধিক হইতে পারে, সেইগুলিকে বলা যাইতে পারে ‘মুতাশাবিহ্’। রূপক ভাষায় বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলি সুস্পষ্টভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণীগুলির আলোকে ব্যাখ্যা করিতে হইবে এবং এই ব্যাখ্যাকে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার সহিত মিলাইয়া দেখিতে হইবে। ‘মুহুকাম’ ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য দেখুন ৫৮ঃ২২ এবং ‘মুতাশাবিহ্’ ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য দেখুন ২৮ঃ৮৬। যেসব আয়াতে আল্লাহ্‌তা’লার আদেশ-নিষেধ ও আইন পূর্ণ আকারে জারি করা হয়, সেগুলিকেও ‘মুহ্‌কাম’ আয়াত বলা যাইতে পারে। আর, যেগুলিতে আদেশ-নিষেধ বা আইন-বিধি আংশিক ভাবে দেওয়া হয় এবং অন্য আয়াতাদির সাথে না মিলাইয়া ঐ আদেশ-নিষেধের পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া যায় না, সেইগুলিকে বলা যায় ‘মুতাশাবিহ্‌’। ‘মুহ্‌কামাত’ সাধারণতঃ আইনের ও বিশ্বাসের বিধিমালা দান করে। ‘মুতাশাবিহাত’ সাধারণতঃ দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়াদি যথাঃ নবীগণের জীবন-কাহিনী, জাতিগণের জীবন-কথা ইত্যাদি বর্ণনা করে এবং ঐসব বর্ণনায় এমন বাগধারা ও প্রকাশ ভঙ্গী ব্যবহৃত হয় যাহার বিভিন্ন অর্থ হইতে পারে। এইরূপ আয়াতগুলির অর্থ করিতে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন যে, এমন কোনও অর্থ যেন করা না হয়, যাহা সর্বজন-বিদিত পরিষ্কার অর্থের কিংবা মূলবিশ্বাসের পরিপন্থী। ‘মুতাশাবিহ্’ আয়াতগুলিতে যে আলঙ্কারিক ও রূপক ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাহা অর্থের ব্যাপকতা ও গভীরতার জন্য এবং অল্প কথায় বহুকিছু প্রকাশের জন্য ধর্মগ্রন্থ সমূহে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে। এরূপ করার প্রয়োজনও আছে। ইহাতে ধর্ম শাস্ত্রের সৌন্দর্য ও লালিত্য বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের পরীক্ষা উপস্থিত হয়, যাহার মাধ্যমে তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতি ও পরিপক্কতা আসে।