‘কাওসার’ শব্দের অন্যান্য অর্থ ছাড়াও একটি প্রধান অর্থ হইল ‘অপরিসীম মঙ্গল’। যে ব্যক্তির মধ্যে সীমাহীন মঙ্গল ও সম্পদ রহিয়াছে এবং সে উহা বহুল পরিমাণে সদা-সর্বদা বিতরণ করে—সেই ব্যক্তিকেও ‘কাওসার’ বলা হয় (মুফরাদাত এবং জরৗর)। এই সূরাতে হযরত নবী করীম (সাঃ)-কে আল্লাহ্তা’লা এমন এক সুমহান ব্যক্তি সাব্যস্ত করিয়াছেন, যাহার উপর তিনি অপরিমিত মঙ্গল ও আশীর্বাদরাজি বর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া ব্যক্ত করিতেছেন। এই সূরাটি মহানবী (সাঃ)-এর জীবনের এমনি একটি সময়ে অবতীর্ণ হইয়াছিল যখন তিনি একেবারে নিঃসম্বল ছিলেন এবং দান করার মত তাঁহার কিছুই ছিল না। তিনি তখন নিরতিশয় দরিদ্র ছিলেন এবং তাঁহার নবুওয়াতের দাবীকে বিবেচনার অযোগ্য বলিয়া গণ্য হইতেছিল। এই সূরা অবতীর্ণ হওয়ার বহু বৎসর পর পর্যন্তও তাহাকে উপহাস ও বিদ্রুপ করা হইয়াছে, তাহাকে বিরোধিতা ও নির্যাতন ভোগ করিতে হইয়াছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত চরম নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যার ষড়যন্ত্র হইতে আত্মরক্ষার জন্য তিনি প্রিয় মাতৃ-নগরী পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহার ছিন্ন-মস্তকের উপর এক বিরাট অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করা হইল। মদীনায় আশ্রয় গ্রহণের পরও কয়েকটি বৎসর পর্যন্ত তাঁহার জীবন প্রতি মুহূর্তে বিপদাপন্ন ও নিরাপত্তাহীন ছিল। তাঁহার শত্রুরা, তাঁহার এইরূপ হীনবল বাহ্যিক অবস্থার সহিত নিজেদের ধনবল ও জনবলের তুলনামূলক বিশাল ব্যবধান দেখিয়া, অতি উৎসাহ ও ব্যগ্রতার সহিত ইসলামের দ্রুত ধ্বংস ও বিনাশের দিন গণিতে ছিল। অতঃপর মহানবী (সাঃ)-এর জীবনের শেষপর্বে, ধনে-জনে, মানে-সম্মানে, জ্ঞানে-গরিমায়, ভক্তি-ভালবাসায়, সর্বোপরি আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা ও প্রাচুর্যে, তিনি এমন মহা সৌভাগ্যের অধিকারী হইলেন যে, মানবেতিহাসে ইহার দৃষ্টান্ত নাই। অতএব আল্লাহ্র দেওয়া ‘কাওসার’-এর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হইল। মক্কার আইনে আশ্রয়-চু্যত ব্যক্তি সমগ্র আরবের ভাগ্য-নিয়ন্তা হইয়া গেলেন, মরুভূমির নিরক্ষর অবহেলিত সন্তান বিশ্বমানবের চিরদিনের শিক্ষকে পরিণত হইলেন। আল্লাহ্তা’লা তাহাকে এমন একখানা কিতাব দিলেন যাহা মানব-জাতির চিরস্থায়ী ও অভ্রান্ত পথ-প্রদর্শক হইয়া গেল। তিনি নিজের মধ্যে ঐশী গুণাবলীর জ্যোতির্মলাকে ধারণপূর্বক, আল্লাহ্র এতই নিকটবর্তী হইয়া গেলেন যে, ইহার অপেক্ষা অধিক নৈকট্য অর্জন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাহাকে এইরূপ তুলনাবিহীন ভক্তদের দল প্রদত্ত হইল যাহাদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য ও শ্রদ্ধার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। যখন বিশ্ব হইতে বিদায় নিবার জন্য তাঁহার প্রভুর কাছ হইতে ডাক আসিল, তখন তিনি সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, তাঁহার উপর ন্যস্ত দায়িত্বাবলীর সাকলাটাই পুরাপুরিভাবে তিনি আদায় করিয়াছেন। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, সর্বপ্রকারের কল্যাণ, জাগতিকই হউক আর আধ্যাত্মিক হউক, পূর্ণ মাত্রায় মহানবী (সাঃ)-এর উপর বর্ষিত হইয়াছিল। অতএব, মহানবী (সাঃ)-এর ন্যায্য প্রাপ্য হিসাবেই ইহা বলা যুক্তিযুক্ত হইয়াছে, “সকল নবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক কৃতকার্য” (এনাসাই, বৃট)।