৩০৭১

বর্ণিত আছে যে, একদিন নবী করীম (সাঃ)-এর একজন স্ত্রী তাঁহাকে মধুমিশ্রিত শরবত পান করিতে দিলেন এবং তিনি তাহা পসন্দও করিলেন বলিয়া মনে হইল। ইহাতে অন্য স্ত্রীদের কেহ কেহ ঈর্ষাবশতঃ রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলিলেন, তাঁহার মুখ হইতে ‘মাগাফীরের’ গন্ধ আসিতেছে। মাগাফীর এক প্রকারের গুল্মের রস যাহা রং ও স্বাদে মধুর মত, কিন্তু যাহা পান করিবার পরে মুখ হইতে দুর্গন্ধ বাহির হয়। মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ লোক ছিলেন। তিনি বলিলেন, তিনি আর মধু পান করিবেন না (বুলদান)। এই ঘটনার সহিত আলোচ্য আয়াতের সম্পর্ক রহিয়াছে বলিয়া সাধারণভাবে মনে করা হইয়া থাকে। কিন্তু এরূপ কাজ মহানবী (সাঃ) দ্বারা অসম্ভব বলিয়া মনে হয় যে, এক বা একাধিক স্ত্রী কর্তৃক প্ররোচিত হইয়া একটি বৈধ বস্তুকে নিজের জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ করার মত চরম পন্থা বাছিয়া লইবেন, বিশেষ করিয়া যে বস্তুকে কুরআনে মানুষের জন্য আরোগ্যকর বলা হইয়াছে (১৬ঃ৭০)। এই ঘটনার বর্ণনাকারী বা বর্ণনাকারীরা কিছু ভুল-বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তির শিকার হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। কেননা, এক বর্ণনাতে দেখা যায় যে, তিনি উম্মুল মো’মেনীন যয়নবের গৃহে শরবত পান করিয়াছিলেন এবং উম্মুল মো’মেনীন আয়েশা ও হাফসা মহানবী (সাঃ) হইতে ভবিষ্যতে মধু না খাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করিয়াছিলেন। আবার অন্য বর্ণনাতে দেখা যায়, হাফসার গৃহে মধুর শরবত পান করিয়াছিলেন এবং আয়েশা, যয়নব ও সফিয়া মিলিয়া রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বুঝাইয়াছিলেন যে, ইহা তো মধু নহে, অন্য কিছু। হাদীস হইতে দেখা যায় যে, দুই বা তিন স্ত্রী মাত্র ঘটনার সহিত জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই সূরার ২ ও ৬ আয়াত হইতে দেখা যায় যে, সকল উম্মুল মো’মেনীনই এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তবে দুই জন ইহাতে নেতৃত্ব দিয়াছিলেন (আয়াত ৫)। এই সকল তথ্য ইহাই প্রকাশ করে যে, মধুর শরবত পান-জনিত সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া নহে, বরং তদপেক্ষা বহু বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনাকে অবলম্বন করিয়া সূরাটি নাযিল হইয়াছে। এই সূরাটির ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া ইমাম বুখারী (কিতাবুল মাযালীম ওয়াল গাস্‌ব) হযতর ইবনে আব্বাসকে উদ্ধৃত করিয়াছেন। হযরত ইবনে আব্বাস বলিয়াছেন, তিনি হযরত উমর হইতে কথা জানিবার জন্য সর্বদা ঔৎসুক্য সহকারে সুযোগের সন্ধানে ছিলেন যে, ঐ উম্মুল মো’মেনীন দুইজন কাহারা, যাহাদের সম্বন্ধে এই সূরাটির ৫ম আয়াতে বলা হইয়াছে–‘যদি তোমরা উভয়ে আল্লাহ্‌র নিকট তওবা কর তাহা হইলে ইহাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হইবে, তোমাদের হৃদয় অবশ্য পূর্ব হইতেই ইহার জন্য ঝুঁকিয়া আছে। একদিন হযরত ইবনে আব্বাস হযরত উমরকে একা পাইয়া জিজ্ঞাসা করিতে না করিতেই হযরত উমর বলিলেন, ঐ দুইজনের একজন আয়েশা ও অপর জন হাফসা। এই বলিয়াই তিনি ঘটনার ইতিবৃত্ত এইভাবে বর্ণনা করিলেন, “একদিন আমার স্ত্রী আমাকে পারিবারিক ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিতে চাহিলে আমি তাহাকে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিলাম যে, আমাকে পরামর্শ দিবার প্রয়োজন নাই। কেননা ঐ সময়ে স্ত্রীলোককে মোটেই পাত্তা দেওয়া হইত না। আমার স্ত্রীও দৃঢ়তার সহিত প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘তোমার মেয়ে হাফসা তো রসূলুল্লাহর (সাঃ) সহিত মুক্ত-মনে দাবী খাটাইয়া কথা বলে এবং রসূলুল্লাহর কোন কথা মনোমত না হইলে তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, অথচ তুমি আমাকে পারিবারিক ব্যাপারেও একটু বলার সুযোগ দাও না। এই কথা শুনিবা মাত্র আমি হাফসার কাছে গেলাম এবং তাহাকে বলিলাম, সে যেন আয়েশার (রাঃ) মত বাড়াবাড়ি না করে, কেননা আয়েশা মহানবী (সাঃ)-এর হৃদয়ের অধিক কাছে। অতঃপর আমি উম্মে সাল্‌মার কাছে এই বিষয়ে কিছু বলিতে চাহিলে তিনি শক্তভাবে আমাকে সতর্ক করিয়া দিলেন, আমি যেন রসুলে পাক (সাঃ) ও তাঁহার বিবিগণের মধ্যেকার ব্যাপারে আমার নাক না গলাই। এই ঘটনার অল্পকাল পরেই নবী করীম (সাঃ) নিজেকে স্ত্রীদের কাছ হইতে দূরে রাখলেন এবং কিছুদিন তাহাদের গৃহে যাওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। জনরব উঠিল যে মহানবী (সাঃ) তাঁহার স্ত্রীগণকে তালাক দিয়াছেন। এই জনবর সত্য কি না তাহা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি (সাঃ) আমাকে না-বোধক উত্তর দান করিলেন।” এই ঘটনা বলিয়া দিতেছে যে, এই সূরার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি মহানবী (সাঃ) কর্তৃক স্ত্রীগণ হইতে সাময়িকভাবে আলাদা থাকার সহিত জড়িত। পূর্ববর্তী সূরাতে স্থায়ী তালাকের বিষয়ে উল্লেখ থাকায়, ইহা খানিকটা সঙ্গত বলিয়া মনে হয় যে, এই সূরার আলোচ্য আয়াতগুলি মহানবী (সাঃ)-এর উপরোক্ত ঘটনার সহিত সম্পর্কিত। তাহা ছাড়া, আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, উপরোক্ত ঘটনা ঘটার পরে পরেই, সূরা আহযাবের ২৯ আয়াত নাযেল হইল এবং মহানবী (সাঃ) সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় স্ত্রীগণকে এই ব্যাপারে মুক্তভাবে নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করার পূর্ণ ক্ষমতা দিলেন যে, তাঁহারা মহানবী (সাঃ)-এর সঙ্গিণী থাকিয়া দরিদ্র, সরল ও কষ্টকর জীবন যাপন করিতে চান, নাকি তাঁহাকে (সাঃ) পরিত্যাগ পূর্বক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েসের জীবন যাপন করিতে চান। এইভাবে স্বীয় অভিমত প্রকাশ করার অধিকার এক এক করিয়া সকল স্ত্রীকেই দেওয়া হইয়াছিল এবং আলোচ্য আয়াতেও সকল স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। তেমনি ৪র্থ আয়াতেও, ব্যাপারটাতে সকল স্ত্রীকেই (রাঃ) জড়িত বলিয়া দেখা যায়। ইহাতে বুঝা যায় যে, এই আয়াত যে ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্ট, তাহাতে সকল উম্মুহাতুল মো’মেনীনই (রাঃ) জড়িত ছিলেন, যাহাতে দুই জন স্ত্রী নেতৃত্ব দিয়াছিলেন। ঘটনাটা ঐতিহাসিকভাবে এই যে, আয়েশা (রাঃ) ও হাফসা(রাঃ)-র নেতৃত্বে মহানবী (সাঃ)-এর স্ত্রীগণ একজোট হইয়া তাহার কাছে দাবী জানাইলেন, যেহেতু মুসলমানগণের অবস্থার প্রভূত উন্নতি হইয়াছে, সেই হেতু উম্মুল মো’মেনীনগণকেও এখন হইতে একটু আরামের ও সাচ্ছন্দ্যের জীবন ভোগ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। কেননা, অন্যান্য মুসলিম মহিলাগণ ইতিমধ্যে এই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করিতেছেন (ফাতহুল কাদীর)। এই প্রসঙ্গকে সামনে রাখিয়া, “তুমি তোমার স্ত্রীগণের সন্তুষ্টি কামনা করিতেছ” কথাগুলির অর্থ এইরূপ দাঁড়ায় যেহেতু তুমি সর্বদাই তোমার সুকোমল ব্যবহার দ্বারা স্ত্রীদিগকে সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট থাক, সেই হেতু, তাহারা এতদূর সাহসী হইয়া গিয়াছে যে, তাঁহারা তোমার রেসালতের উচ্চতম মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়াই যাহা ইচ্ছা চাহিয়া বসে।’ মারিয়া কুবতিয়া সম্পর্কীত খৃস্টানদের রচিত তথাকথিত ঘটনা এতই অবাস্তব কল্পনাবিলাস যে, ইহা সম্পূর্ণভাবে বিবেচনার অযোগ্য। ইহার পিছনে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। মহানবী (সাঃ) কখনও কৃতদাসী রাখেন নাই। তবে মরিয়ম নাম্নী মহানবী (সাঃ)-এর একজন স্ত্রী ছিলেন, যিনি সম্মানীয়া উম্মুল মো’মেনীন ছিলেন।