কিছু বিদ্বেষপরায়ণ সমালোচক উদ্ভট গল্প তৈরী করিয়াছে যে, মহানবী (সাঃ) অন্ততঃ একবার শয়তানের কবলে পড়িয়াছিলেন। তাহারা বলেন যে, মক্কাতে মহানবী (সাঃ) একদিন বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর একটি সম্মিলিত ক্ষুদ্র সমাবেশে এই সূরাটি পাঠ করিতেছিলেন। যখন তিনি এই আয়াতগুলিতে আসিলেন তখন শয়তান চালাকি করিয়া তাঁহার মুখ হইতে নিম্নলিখিত বাক্যটি পাঠ করাইয়া লইল- “তিল্কাল গারানিকাল উলা ওয়া ইন্না শাফায়াতাহুন্না লাতুরতাজা” অর্থাৎ এই দেবতাগুলি খুবই উচ্চস্তরের এবং ইহাদের শাফায়াত (মধ্যবর্তিতা) সকলেই আশা করে (যুরকানী)। এই বানানো গল্পটিই, তাহাদের কাছে ‘মুহাম্মদের বিচ্যুতি বা পৌত্তলিকতার সহিত সন্ধি’ বলিয়া খ্যাত। তাহারা এই ভিত্তিহীন গল্পটি পাইয়াছে ওয়াকিদী নামক একজন অতি-মিথ্যুক হাদীস তৈরীকারকের কাছ হইতে অথবা তাবারীর বর্ণনা হইতে, যিনি নির্বিচারে যাহা শুনিতেন তাহাই লিপিবদ্ধ করিতেন এবং বাছ-বিচার না করিয়া সকলের কথাই বিশ্বাস করিতেন। এই বিদ্বেষী সমালোচকেরা এমন এক মহামানবের উপর এই ঘৃণ্য বক্তব্য আরোপ করিতে ঔদ্ধত্য দেখাইল, যাহার সারাটা জীবনই পৌত্তলিকতার অসারতা-প্রমাণে ও ইহার নিন্দাবাদে অতিবাহিত হইয়াছিল, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রামই ছিল তাঁহার ব্রত। এই পবিত্র ব্রত পালনে তিনি ভীতিহীন আনুগত্য, বিরতিহীন উদ্দীপনা, আপোষহীন মনোভঙ্গী ও অতুলনীয় সংকল্প দেখাইয়াছেন। শত তোষামোদ, শত লোভ-প্রদর্শন, বশীকরণের শত চেষ্টা, সর্বোপরি হত্যার ভীতি, এই সবকিছুই তিনি তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এমন কি, তাঁহার এই মহাব্রত হইতে তিনি এক ইঞ্চিও সরেন নাই। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাঁহার দৃঢ়চিত্ততার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ্তা’লাই দিয়াছেন (১৮ঃ৭, ৬৮ঃ১০)। পূর্বাপর সমগ্র প্রসঙ্গটি পর্যালোচনা করিলেও দেখা যাইবে যে, এই গল্পটি একেবারেই ভিত্তিহীন। কেবলমাত্র পরবর্তী কয়েকটি আয়াতই নহে, বরং সমগ্র সূরাটিই পৌত্তলিকতার নিন্দাবাদ এবং তওহীদ প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সূরাটির এত সুস্পষ্ট বক্তব্যও মহানবী (সাঃ)-এর ছিদ্রান্বেষী সমালোচকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে নাই! ইতিহাসের তত্ব-তথ্যের একটি পাতাও মহানবী (সাঃ)-এর তথাকথিত বিচ্যুতির সমর্থন করে না। এই কল্পিত কাহিনীকে কুরআনের সকল তফসীরকারগণই ‘মিথ্যা-গল্প’ বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। এঁদের মধ্যে রহিয়াছেন ইবনে কাসীর ও ইমাম রাযী। মুসলিম চিন্তাবিদগণের অন্যতম বিজ্ঞান-মনা হাদীস-বেত্তাগণ যথা ‘আইনী’, ‘কাজী আইয়াদ’ ও ‘নওয়াবী’—সকলেই এই গল্পকে ‘কল্পনার আবিষ্কার’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলনের (সিহাহ্ সেত্তাহর) কোথাও এই গল্পটির চিহ্ন পর্যন্ত নাই। সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত হাদীস সংকলক ইমাম বুখারী (রঃ), যিনি এই গল্পের সৃষ্টিকারী ওয়াকিদির সমসাময়িক ছিলেন, তিনিও তাঁহার সহীহ্ বুখারীতে এই গল্পের বা কাহিনীর উল্লেখ করেন নাই। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক, যিনি তাঁহার ৪০ বৎসর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন, তিনিও এই গল্পটির কোন উল্লেখ করেন নাই। কাস্তালানী এবং যুরকানী, অন্যান্য কয়েকজন সুযোগ্য আলেমের সহযোগে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মহানবী (সাঃ) সম্মিলিত সভায় যখন এ সূরাটি তেলাওয়াতের সময়ে এই আয়াতগুলিতে পৌঁছলেন, তখন দুষ্ট-বুদ্ধি প্রণোদিত কোন অবিশ্বাসী পৌত্তলিক উল্লিখিত শব্দগুলি উচ্চঃস্বরে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছিল। তখন, কুরআন তেলাওয়াতের সময় সংশয় সৃষ্টির জন্য এইভাবে বাধা প্রদান পূর্বক স্ববাক্য সংযোজন করা অবিশ্বাসীদের উপহাসের অঙ্গ বিশেষ ছিল। ইহা ছিল, বলিতে গেলে, তাহাদের মজ্জাগত অভ্যাস। ইতিহাস ঘাটিয়া প্রমাণ মিলিয়াছে যে, জাহেলিয়াতের যুগে কুরায়শগণ যখন কা’বার চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করিত, তখন তাহারা উপরোক্ত পৌত্তলিক শব্দগুলি উচ্চারণ করিত (মু’জামুল বুলদান, ৫ম খণ্ড উজ্জা’ শীর্ষক অধ্যায়)। ইহাও বলা হইয়া থাকে যে, উপরোক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে, সূরা হজ্জের ৫৩ আয়াত নাযেল হইয়াছিল। একথার অসারতা এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায় যে, যখন আমরা দেখি যে, সূরা নাজম্ অবতীর্ণ হইয়াছিল নবুওয়াতের পঞ্চম বৎসরে, আর সূরা হজ্জ অবতীর্ণ হইয়াছিল নবুওয়াতের দ্বাদশ-ত্রয়োদশ বৎসরে। আরও দেখুন ১৯৬২ টীকা।