২৮৫১

‘যাওয়াজা শাইয়ান বিশাইয়িন’ অর্থ, সে একটি বস্তুর সহিত ঐ বস্তুটিরই জোড় তৈরী করিল, সে ইহাকে ইহারই সদৃশ বস্তুর সহিত একত্রিত করিল বা মিলাইল। ‘হুর’ শব্দটি, ‘আহ্ওয়ার’ (পুঃ) ও ‘হাওরা’ (স্ত্রী) উভয় শব্দেরই বহুবচন এবং এই শব্দটি দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যাহার চক্ষুদ্বয়ের শ্বেতাংশ অত্যুজ্জ্বল সাদা ও কৃষ্ণাংশ অত্যুজ্জ্বল কালো এবং তৎসহ সারাটা শরীরও অত্যন্ত উজ্জল, সুন্দর অঙ্গ সৌষ্ঠবে পরিপূর্ণ। ‘আহ্ওয়ার’ শব্দের দ্বারা, পরিষ্কার, তীক্ষ, পবিত্র, দীপ্ত-বুদ্ধিও বুঝাইয়া থাকে। ‘ঈন’ শব্দটি ‘আইয়ান’ ও ‘আইনা’ শব্দদ্বয়েরই বহুবচন, এই শব্দদ্বয় যথাক্রমে সুন্দর, বড় বড়, কৃষ্ণ-চক্ষু বিশিষ্ট পুরুষ বা স্ত্রীলোককে বুঝায়। অবশ্য ‘আইনা’ শব্দের দ্বারা একটি উত্তম সৌকর্যমণ্ডিত বাক্য বা শব্দকেও বুঝাইয়া থাকে (লেইন, মুফরাদাত এবং তাজ)। অতএব ‘হুর’ ও ‘ঈন’ শব্দদ্বয় মিলিয়া, দেহ ও মনের তথা ব্যক্তির ও চরিত্রের সৌন্দর্য ও পবিত্রতা প্রকাশ করে। পরকালের জীবন ইহকালের জীবনেরই প্রতিফলন, প্রতিকৃতি ও প্রকাশ্য ছবি। পরজগতের পুরস্কার ও শাস্তি ইহজগতের কৃত-কর্মের প্রতিচ্ছবি ও মূর্ত-রূপায়ণ বিশেষ। বেহেশ্‌ত ও দোযখ কোন বস্তুজগত নহে, তবে ইহা অবশ্যই সত্য যে, ইহা দৃশ্যমান ও ভোগযোগ্য হইবে। ইহাকে কেহ বস্তু-জগৎ বলিলেও বলিতে পারে, তবে আসলে তাহা ইহজগতের আধ্যাত্মিক অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা রচিত ভুবন ব্যতীত অন্য কিছু নহে। ইহজগতের প্রতি ঐকান্তিক প্রেমাকষর্ণে মগ্ন থাকিয়া যাহারা দেহত্যাগ করে, তাহারা পরকালে নিজেদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ দেখিতে পাইবে। ইহকালের অদম্য ভোগ-বিলাস ও লোভাতুর হা-হুতাশ পরকালে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার রূপ পরিগ্রহ করিবে। তেমনি, সৃষ্টিকর্তা প্রভুর প্রতি প্রেম-প্রীতি ও ভক্তি-ভালবাসা পরকালে তৃপ্তিদায়ক উৎকৃষ্টতম শরবৎ রূপে প্রেমিকের কাছে উপস্থিত করা হইবে…..ইত্যাদি। এইরূপভাবে বেহেশতে উদ্যান, স্রোতস্বিনী, ঝর্ণা, দুগ্ধ, মধু, পাখীর মাংস, সরাব, ফল-ফলাদি, সিংহাসন, সুজন-সার্থী ও অন্যান্য উপভোগ্য সামগ্রী থাকিবে—ঐগুলি এই জগতের বস্তু হইবে না, বরং এই জগতের জীবনের আধ্যাত্মিক বিষয়াবলীও কর্মফলের দ্বারা রূপায়িত বস্তু-নিচয় হইবে। ‘যাওয়াজনা’, ‘হুর’ এবং ‘ঈন’ এই শব্দত্রয়ের ব্যাখ্যা উপরে যথাস্থানে দেওয়া হইয়াছে। তাহাতে দেখা যায় যে, আল্লাহ্‌তা’লার ধার্মিক বান্দাগণকে বেহেশ্‌তে উজ্জ্বল ও আধ্যাত্মিক জ্যোতির্ময় সৌন্দর্যে মণ্ডিত মুখমণ্ডলাধিকারী সঙ্গী-সাথীদের সাথে বাস করিতে দেওয়া হইবে, অথবা সুন্দরী, কুমারী নারীগণকে তাহাদের পবিত্র সাথী করা হইবে, অর্থাৎ তাহাদের আপন স্ত্রী করা হইবে। পরকালের জীবন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করিতে হইলে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের পুরস্কার ও শাস্তির তাৎপর্য বুঝিতে হইলে, এই কথাটি ভালভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, পরজীবন ইহজীবনেরই ধারাবাহিক অবস্থা মাত্র। মানুষের আত্মা যখনই এই মাটির দেহ ত্যাগ করে, তখনই ঐ আত্মাকে একটা নূতন দেহ পরাইয়া দেওয়া হয়। কেননা, দেহ ব্যতীত আত্মা উন্নতি করিতে পারে না, আশীর্বাদও উপভোগ করিতে পারে না। শাস্তিও ভোগ করিতে পারে না। নূতন দেহটি অবশ্যই সেইরূপ সূক্ষ্ম অনুভূতি-সম্পন্ন হইবে ইহকালে আত্মা যতটুকু সূক্ষ্মানুভূতি সম্পন্ন ছিল। যেহেতু এই নূতন দেহটি, আমাদের ইহকালীন দেহ হইতে ভিন্নতর হইবে এবং যাহার প্রকৃতি ইহলোকে উপলব্ধিযোগ্য নহে, তেমনি পরকালের শাস্তি ও পুরস্কারসমূহের প্রকৃতি ও গুণাগুণ ইহকালে থাকা অবস্থায় অবোধগম্যই থাকিবে। এই জন্যই কুরআনে বলা হইয়াছে, ‘বস্তুতঃ কেহই জানে না যে, তাহাদের জন্য তাহাদের কৃত-কর্মের প্রতিদান স্বরূপ কি কি নয়নতৃপ্তিকর বস্তু গোপন করিয়া রাখা হইয়াছে’ (৩২ঃ১৮)। মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘বেহেশ্‌তের আশীর্বাদ ও নেয়ামতসমূহ, না কোন চক্ষু দেখিয়াছে, না কোন কর্ণ শুনিয়াছে, না কোন মন উপলব্ধি করিয়াছে’ (বুখারী)। কুরআনে বেহেশতের একটি ছোট বর্ণনা হইল, ‘বেহেশতে পাপ থাকিবে না, বৃথা বাক্যালাপ পর্যন্ত থাকিবে না’ (৫৬ঃ২৬-২৭)। ইহা দ্বারাই ধার্মিকের জন্য প্রতিশ্রুত স্বর্গরাজ্যের একটি উজ্জ্বল চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠে। এই প্রসঙ্গে ২৩২৬ টীকাও দেখুন।