নবী করীম (সাঃ)-এর মত এত উচ্চমার্গের কোন মানুষ, যিনি নৈতিক অধঃপতনের গর্ভে নিমজ্জিত একটি জাতিকে আধ্যাত্মিক উন্নতির চরম শিখরে লইয়া গেলেন, তিনি কখনও বিন্দু মাত্র নৈতিক দোষে দোষী হইতে পারেন না। তবুও তাঁহার বিরুদ্ধাচারীরা অনর্থক দোষারোপ করিয়া তাঁহাকে দোষী সাব্যস্ত করিতে নিষ্ফল চেষ্টা করে। এই আয়াতের একটি সোজা-সরল, শব্দ হইল ‘যানবুন’। এই ‘যানবুন’ শব্দটির আশ্রয় নিয়া চরিত্র হননের অপচেষ্টা করা হইয়াছে। আসলে এই শব্দটির অর্থ হইল মানুষের স্বভাব-সুলভ দুর্বলতা ও ভ্রান্তি যাহা অনিষ্টকর ফলোদয় ঘটায়। পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হইয়াছে, প্রতিশ্রুত বিজয় আসার সাথে সাথে এত অগণিত লোক ইসলামে প্রবেশ করিবে যে, তাহাদিগকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং তাহাদের চারিত্রিক পরিবর্তন ও উৎকর্ষ সাধন এক দুঃসাধ্য কাজ হইয়া দাঁড়াইবে। সেই কাজে অনেক স্বাভাবিক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকিয়া যাইবে। এই আয়াতে ইহাই বুঝানো হইতেছে যে, আল্লাহ্তা’লা রসূলে করীম (সাঃ)-কে ঐসব ত্রুটি-বিচ্যুতির অশুভ ফলাফল হইতে রক্ষা করিবেন। এই জন্যই কুরআনের যেসব স্থানে মহানবী (সাঃ)-কে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে, সেই সব স্থানেই তাহাকে নিজের ‘যানব’ (স্বভাব-সুলভ দুর্বলতা) হইতে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করিতে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে, যাহাতে তাঁহার মানব-সুলভ অসামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতা তাঁহার সুমহান উদ্দেশ্য সম্পাদনের পথে বাধা হইয়া না দাঁড়ায়। প্রণিধানযোগ্য বিষয়টি এই যে, ‘জুনাই’, ‘জুরম’, ‘ইসম’ এবং ‘যন্ব’ এই চারিটি শব্দ কাছাকাছি ধরণের অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু প্রথমোক্ত তিনটি শব্দ আল্লাহ্তা’লার নবীগণের সম্বন্ধে কুরআনে একটি স্থানেও ব্যবহৃত হয় নাই। ইহা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ তিনটি শব্দের যে মন্দ তাৎপর্য রহিয়াছে, ‘যানব’ শব্দটির মধ্যে তাহা নাই। ইহা ছাড়াও, যদি একান্তই ‘যান্ব’ শব্দটি পাপ বা অপরাধ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াও থাকে, তাহা হইলেও কুরআনে ব্যবহৃত বাগ্ধারা অনুযায়ী যান্বাকা অর্থ দাঁড়াইবে, ‘তুমি যেসব অপরাধ করিয়াছ বলিয়া তাহারা অপবাদ দেয়, অথবা তোমার বিরুদ্ধে তাহারা যেসব অপরাধ করিয়াছে’। ‘যানব’ শব্দটির শেষোক্ত অর্থটি নিলে, এই আয়াতের ‘লাকা’ শব্দটির অর্থ দাড়াইবে তোমার খাতিরে। কুরআনের অন্যত্র (৫ঃ৩০), ঠিক এই ধরণের একটি দৃষ্টান্ত হইলঃ ‘ইসমী’ (আমার পাপ), যাহার সঠিক তাৎপর্য হইল, “আমার বিরুদ্ধে যে সকল পাপকার্য সংঘটিত হইয়াছে।” এইভাবে আলোচ্য আয়াতের মর্মার্থ ইহাই দাঁড়াইতেছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি যাহা মহানবী (সাঃ)-এর জন্য মহাবিজয়ের সূচনা করিল, উহার ফলে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি যেসব পাপ, অপরাধ, দোষ ইত্যাদি শত্রুরা এতদিন আরোপ করিয়া আসিয়াছিল যথা,—তিনি প্রবঞ্চক, জুয়াচোর, আল্লাহ্ ও মানবের বিরুদ্ধে মিথ্যারোপকারী ইত্যাদি— এই সব কিছুই মিথ্যা প্রতিপন্ন হইবে। কেননা, সকল প্রকারের শত্রু-মিত্র এখন মহানবী (সাঃ)-এর অনুসারীগণের সহিত অবাধে মিলা-মিশা ও আলাপ-আলোচনার সুযোগে তাঁহার সম্বন্ধে প্রকৃত তত্ব, তথ্য ও সত্য অবগত হইতে পারিবে। এই অর্থও হইতে আপত্তি নাই যে, তোমার শত্রুরা তোমার বিরুদ্ধে যে সব পাপকার্য ও অপরাধ করিয়াছে, কেবল তোমারই খাতিরে, তাহাদের সেই সব পাপ ও অপরাধ ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইবে। প্রকৃত পক্ষে, বাস্তবে তাহাই ঘটিয়াছিল। যখন মক্কার পতন ঘটিল এবং আরব জাতি ইসলাম গ্রহণ করিল, তখন তাহাদের পূর্বকৃত পাপ ও অপরাধসমূহ ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইল। প্রসঙ্গও এই অর্থই সমর্থন করে। অন্যথায় ‘যান্ব’ শব্দের অর্থ ‘পাপ’ ধরিয়া লইয়া, এখানে পাপ মোচনের কথা বলা হইয়াছে মনে করিলে, রসূলে করীম (সাঃ)-এর সুস্পষ্ট বিজয় লাভ ও তাঁহার প্রতি আল্লাহ্তা’লার পরিপূর্ণ অনুগ্রহ বর্ষণ কথাগুলির সাথে পাপ-মোচনের কথা মোটেই খাপ-খায় না। অতএব এই অর্থ এখানে অচল, উপরে বর্ণিত অর্থ ও ব্যাখ্যাই সঠিক।