আল্লাহ্তা’লার আদেশক্রমে ইব্রাহীম (আঃ) কাহাকে কুরবাণী রূপে পেশ করিয়াছিলেন—ইসমাঈলকে না ইসহাককে—এই বিষয়ে কুরআন ও বাইবেলে ভিন্ন ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। বাইবেলের মতে কুরবানীর পাত্র ছিলেন ইস্হাক (আঃ) (আদি পুস্তক-২২ঃ২)। এই ব্যাপারে বাইবেলে পরস্পর বিরোধী কথা পাওয়া যায়।বাইবেল বলে আব্রাহামকে আদেশ করা হইয়াছিল, তাঁহার একমাত্র সন্তানকে কুরবানী করিতে, কিন্তু ইস্হাক(আঃ) কোন কালেই তাঁহার একমাত্র সন্তান ছিলেন না। ইস্হাকের (আঃ) চাইতে ইসমাঈল (আঃ) ১৩ বৎসরের বড় এবং এই ১৩ বৎসর তিনি ইব্রাহীম (আঃ)-এর একমাত্র পুত্র ছিলেন। প্রথম পুত্র ও একমাত্র সন্তান হিসাবে তিনি পিতার কাছে অত্যধিক আদরের ছিলেন। অতএব, ইহাই যুক্তি যুক্ত যে, আল্লাহ্তা’লা ইব্রাহীম (আঃ)-কে তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয় পাত্র, একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকেই (আঃ) কুরবানী করার আদেশ দিয়াছিলেন। খৃষ্টান পাদ্রীদের কেহ কেহ অনর্থক বলিয়া থাকেন যে, ইসমাঈল দাসীর পুত্র হওয়াতে তাঁহার মাঝে রক্ত-মাংসের (কামনা বাসনার) আধিক্য ছিল এবং ইস্হাক স্বাধীনা রমনীর সন্তান হওয়াতে, তিনিই আল্লাহ্র প্রতিশ্রুত পবিত্র সন্তান (গালাতীয় ৪ঃ২২-২৩)। একথা মোটেই সত্য নয় যে, হযরত ইসমাঈলের মা হযরত হাজেরা দাসী ছিলেন। তাই বাইবেলে আমরা দেখিতে পাই যে, হযরত ইসমাঈলকে বারংবার ইব্রাহীমের(আঃ) পুত্র বলা হইয়াছে, যেইরূপ ইস্হাককে (আঃ) বলা হইয়াছে (আদি পুস্তক-১৬ঃ১৬; ১৭ঃ২৩, ২৫)। তাহা ছাড়া একই ধরণের বিরাট-ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি রহিয়াছে ইসমাঈল ও ইস্হাক উভয়ের জন্যই (আদি পুস্তক-১৬ঃ১০, ১১, ১৭ঃ২০)। বাইবেলে মারওয়া পাহাড়কে মোরিয়া বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে এবং ইসমাঈল নামের স্থলে ইস্হাক বসানো হইয়াছে। ‘মারওয়া’ মক্কার অদূরে একটি পাহাড়, যেখানে ইব্রাহীম (আঃ) তদীয় শিশু-পুত্র ইসমাঈলসহ হাজেরাকে আল্লাহ্র ইচ্ছায় ছাড়িয়া গিয়াছিলেন। মারওয়া স্থলে ‘মারিয়া’ আর ইসমাঈলের স্থলে ইস্হাক এই দুই শব্দ বদল ব্যতীত বাইবেলে সমর্থনের নিমিত্ত আর কোন কিছু নাই, যাহা দ্বারা প্রমাণ করা যাইতে পারে যে, ইস্হাকই ছিলেন কুরবানীকৃত পুত্র, ইসমাঈল নহেন। প্রনিধানযোগ্য বিষয় হইল, ইস্হাককেই কুরবানী দেওয়া হইয়াছিল বলিয়া ইহুদী ও খৃষ্টানগণ মনে করিলেও তাহাদের কোন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এতবড় একটা ঘটনার কোন চিহ্নই পরিদৃষ্ট হয় না। তাহারা যাহা বলে তাহা যদি সত্যই হইত তাহা হইলে তাহারা এত মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘটনাটা বিস্মৃত হইতনা, কোননা কোনভাবে তাহা ধর্মাচারে জাগরূক থাকিত।অপরদিকে, হযরত ইসমাঈলের আধ্যাত্মিক সন্তান মুসলমানেরা বহু উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে, ইসমাঈলের ঐ কুরবানীর কথা স্মরণ করে এবং নিজেরা পশু কুরবানী করিয়া জিলহজ্জ মাসের দশম দিনে সারাবিশ্বে তুমুল সাড়া জাগাইয়া তোলে। মুসলমান কর্তৃক দুম্বা, ছাগল ইত্যাদি কুরবানী করার এই সার্বজনীন ধর্মীয় আচার বিতর্কের উর্ধ্বে এবং প্রমাণ করে যে, হযরত ইব্রাহীম কুরবাণীর জন্য ইস্হাককে নয় বরং ইসমাঈলকেই পেশ করিয়াছিলেন ইব্রাহীম (আঃ)-কে তাঁহার স্বপ্ন-দৃষ্ট কুরবানী একেবারে আক্ষরিকভাবে পালন করিতে হয় নাই, যদিও তিনি ও হযরত ইসমাঈল(আঃ) আক্ষরিকভাবে উহা পালন করিতেই প্রস্তুত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্ন-দৃষ্ট কুরবানী তখনই এক হিসাবে পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, যখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে মক্কার ধু ধু উপত্যকায় আশ্রয়হীন অবস্থায় ছাড়িয়া গিয়াছিলেন। এই যে বীরত্বের কার্য, ইহারই মাঝে হযরত ইসমাঈলের কুরবানীর চিহ্ন ও প্রতীক রহিয়াছে। প্রথমে ইব্রাহীমের(আঃ) প্রতি আল্লাহ্র এই নির্দেশ যে, নিজ পুত্রকে কুরবানী কর এবং কুরবানীর মুহুর্তকাল পূর্বে এই নির্দেশ যে, থাম! হুকুম পালন করা হইয়া গিয়াছে—এই দুই নির্দেশের মধ্যে উদ্দেশ্য ইহাই ছিল যে, এখন হইতে মানুষ কুরবানী নিষিদ্ধ করা হইল। কেননা, এই অমানবিক নরহত্যা ধর্মের নামে বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে তখন প্রচলিত ছিল।