‘হামালাল আমানাতা’ অর্থ আল্লাহ্র দেওয়া আইন-কানুন, যাহা মহামূল্য আধ্যাত্মিক সম্পদ, তাহা সংরক্ষণের ও সঠিকভাবে বন্টনের দায়িত্ব সে (মানুষ) নিজের কাঁধে তুলিয়া লইল, সে গচ্ছিত বিশ্বাস ভঙ্গ করিল। যালেম এর মাত্রাধিক্য বুঝাইতে ‘যালুম’ শব্দ ব্যবহৃত যাহার অর্থ অতিমাত্রায় অত্যাচারকারী। যালামা-এর (কর্তৃবাচ্য হইল যালেম) অর্থঃ সে জিনিষটি ভুল স্থানে রাখিয়াছিল। আর ‘যালামাহু’ অর্থ সে নিজের উপরে এমন বোঝা চাপাইল, যাহা বহন করিবার শক্তি তাহার নাই। ‘জাহেল’ শব্দ দ্বারা অবহেলাকারী, বোকা, উদাসীন বুঝায়। আর ‘জাহূল’ দ্বারা অতিশয় অবহেলাকারী, অতিরিক্ত মাত্রায় উদাসীন ও বদ্ধ বোকা বুঝায় (লেইন)। মানুষকে প্রকৃতিগতভাবেই বিরাট মেধা ও মহা সামর্থ্য দেওয়া হইয়াছে যাহাতে সে ঐশী-গুণাবলী নিজের মধ্যে আহরণ করিয়া উহা বিকাশ ও প্রকাশ করিতে পারে এবং নিজেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিভূ বানাইতে পারে (২ঃ৩১)। ইহা এমনই এক মহান আমানত ও দায়িত্ব, যাহা বিশ্বচরাচরের মধ্যে একমাত্র মানুষ ছাড়া অন্য কেহই সম্পাদন করার যোগ্যতা রাখে না। অন্যান্য জীব বা বস্তু, ফিরিশ্তা, আকাশমালা, পৃথিবী এবং পর্বতমালা এই দায়িত্বের বোঝা বহনে সম্পূর্ণ অক্ষম। তাই ইহা বহন করিতে তাহারা যেন অস্বীকার করিল। তবে মানুষ ইহা বহন করিতে স্বীকৃত হইল। কেননা, ইহা বহনে কেবলমাত্র মানুষই সক্ষম। সে ‘যালূম’ (নিজের প্রতি অধিক অত্যাচারকারী) ও জাহূল (নিজের প্রতি অবহেলাকারী) হওয়ার যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ সে তাহার সৃষ্টিকর্তার খাতিরে যে কোনও ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট বরণ করিতে পারে (যালুম) এবং সে নিজের প্রতি উদাসীন ও অবহেলাকারী (জাহূল) হইতে পারে এই অর্থে যে, দায়িত্ব ও আমানতের বোঝা বহন করিতে যাইয়া সে নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতে সক্ষম। ‘আল্-আমান’ বলিতে কুরআনী শরীয়াত ধরিয়া লইলে এবং ‘আল্ ইনসান’ বলিতে পূর্ণতম মানব মহানবী (সাঃ)-কে বুঝাইলে, এই আয়াতের অর্থ দাঁড়াইবেঃ আকাশমালা ও পৃথিবীর মাঝে প্রাণী-অপ্রাণী যাহা কিছু আছে, তাহাদের মধ্যে মহা নবী (সাঃ)-ই হইলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি যাঁহার উপর পূর্ণতম ও শেষ বিধান কুরআন অবতীর্ণ হইল। কারণ, অন্যান্য মানুষই বলুন বা অন্যান্য অস্তিত্বের কথাই বলুন, তাহাদের কাহারও এতবেশী মহৎ গুণাবলী ছিল না, যাহা এই মহান ও গুরুভার দায়িত্ব পালনের ও সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য ছিল। ‘হামালা’র অর্থ বিশ্বাস ভঙ্গ ধরিলে এই আয়াতটির অর্থঃ ঐশী-বিধানের আমানত (বিশ্বাসপূর্ণ গচ্ছিত দায়িত্ব) মানুষের উপরে, পৃথিবীর প্রাণী অপ্রাণী সকলের উপরে এবং আকাশস্থিত সকলের উপরেই ন্যস্ত করা হইল৷ মানুষ ছাড়া সকলেই বিশ্বাস ভঙ্গ করিতে অস্বীকার করিল। কারণ তাহাদিগকে যে সব বিধানের অধীন করা হইল, তাহারা সেইগুলি বিশ্বস্ততার সহিত মানিয়া চলিল। সমগ্র প্রকৃতি প্রাকৃতিক বিধানের প্রতি বিশ্বস্ত রহিল, ফিরিশ্তারাও তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবনত মস্তকে বিশ্বস্ততার সহিত সম্পাদন করিতে লাগিল (১৬ঃ৫০-৫১)। তবে মানুষই একমাত্র ব্যতিক্রম। তাহাকে ইচ্ছাশক্তি ও বিবেচনা-শক্তি দেওয়া হইয়াছে বলিয়া একমাত্র সে-ই ঐশী বিধানকে অমান্য করে, কেননা সে অন্যায়কারী এবং নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি অবহেলাকারী ও উদাসীন। আয়াতটির এই অর্থ ৪১ঃ১২ দ্বারা সমর্থিত।