২৩৬২

এই আয়াতটি ২৯ ও ৩০ আয়াতের সহিত মিলাইয়া পাঠ করা উচিত। শেষোক্ত দুইটি আয়াতে নবী করীম(সাঃ)-এর মহিয়সী বিবিগণকে, তাঁহার সঙ্গিণী হিসাবে থাকিয়া কষ্টসাধ্য জীবন যাপন করা নতুবা তাহাকে ছাড়িয়া পার্থিব জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বরণ করা, এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বাছিয়া নিবার সুযোগ দেওয়া হইল এবং মহিয়সী বিবিগণ সকলেই নবী করীম (সাঃ)-এর চিরসঙ্গিণী হিসাবে থাকিয়া যাইবার পক্ষে নিজেদের মত ব্যক্ত করিলেন। এই আয়াতে পরোক্ষভাবে মহানবী (সাঃ)-এর স্ত্রীগণের মতামত ও সিদ্ধান্তের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতেছে। তাহাদের প্রতিক্রিয়া ও উত্তর ইতিহাসের পাতায় লিখিত আছে, কিন্তু কুরআনের কোথায়ও প্রকাশ্যভাবে বর্ণিত হয় নাই। তাঁহাদের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত, মহানবী (সাঃ)-এর সহিত তাহাদের সম্পর্ক অনেকটা শূন্যে ঝুলিয়া থাকার মত ছিল। মহানবী (সাঃ)-এর বিবিগণ যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তা ও বাসনাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়া, তাহার চিরসঙ্গিণী হইয়া থাকিবার আগ্রহ প্রকাশ করিলেন, মহানবী (সাঃ) ও তেমনি (যাহাকে পসন্দ রাখিতে এবং যাহাকে অপসন্দ ছাড়িয়া দিতে পারেন (আয়াত-৫২), এই সুযোগ পাইয়াও), তাহাদের অনুভূতির প্রতি বিবেচনাশীল হইয়া মহানবী (সাঃ) সকলকেই স্ত্রীরূপে রাখিয়া দিলেন। মহানবী (সাঃ)-এর বহু বিবাহ, বড়ই সুমহান ও সু-উচ্চ বিবেচনার ফল। এই ব্যাপারে মূর্খ ও হীনমনা সমালোচকগণ তাঁহার প্রতি যেসব নীচ উদ্দেশ্য আরোপ করে, তিনি ইহার বহু বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন। একমাত্র হযরত আয়েশার সহিত বিবাহ ছাড়া, (পরবর্তী অবস্থাবলী এই বিবাহের ন্যায়সঙ্গতা প্রমাণ করিয়াছে), তাঁহার সকল বিবাহই বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তাদের সাথে হইয়াছিল। তিনি বিধবা হাফসাকে বিবাহ করিলেন, যাহার স্বামী বদরের যুদ্ধে শহীদ হইয়াছিলেন। তিনি যয়নাব বিনতে খোজাইমাহকে বিবাহ করিলেন, যাহার স্বামী উহুদের যুদ্ধে শহীদ হইয়াছিলেন এবং উম্মে সালমাহ যাহার স্বামী ৪র্থ হিজরীতে মারা গেলেন, আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবা, যাহার স্বামী ৫ম বা ৬ষ্ঠ হিজরীতে আবিসিনিয়াতে মারা গেলেন, বিধবা জুয়ায়রীয়া ও বিধবা সফিয়াকে যথাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ৭ম হিজরীতে নিজেদের গোত্রের সহিত সম্পর্ক স্থাপন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী (সাঃ) তাহাদিগকে বিবাহ করিলেন। ইহা বড়ই প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার যে, মহানবী (সাঃ) জুয়াইরীইয়াকে বিবাহ করার ফলে, মুসলমানগণ বনি মুস্তালিক গোত্রের একশত পরিবারকে বন্দী অবস্থা হইতে মুক্ত করিয়া দিলেন। মায়মূনাহ একজন সুশিক্ষিতা বিধবা ছিলেন। তিনি মহানবী (সাঃ)-এর পানিগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করিলে, মুসলমান মহিলাগণের শিক্ষা-দীক্ষার খাতিরে, তিনি তাহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন। পঞ্চম হিজরীতে তিনি যায়েদের তালাক-প্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করিয়া আরব ভূমির একটি পুরাতন কুপ্রথার মূলোচ্ছেদ করেন। সাথে সাথে একজন সম্ভান্ত বংশীয় মহিলার তালাক-প্রাপ্ত জনিত মানসিক যন্ত্রণার অবসান ঘটাইলেন। সপ্তম হিজরীতে কৃতদাসত্ব হইতে সদ্যমুক্ত মারিয়া কিবতিয়াকে বিবাহ করিয়া তাঁহাকে ‘বিশ্বাসীগণের মাতার’ (উম্মুল মো’মেনীনের) মর্যাদায় উন্নীত করিলেন এবং কৃত-দাস প্রথার মূলে কুঠারাঘাত হানিলেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তাগণের সহিত বিবাহের পিছনে এইসব সৎ প্রবৃত্তি ও সমাজ হিতৈষণার মহান উদ্দেশ্যই কার্যকরী ছিল। নতুবা ঐ বয়সে গত-যৌবনা, অখ্যাত সুন্দরীদের বিবাহ করার কোন ব্যক্তিগত প্রয়োজনই তাঁহার ছিল না তাঁহার সমালোচকেরা এই সমুজ্জ্বল সত্যের দিকে একবার তাকাইয়াও দেখেন না যে, এই মহামানব পঁচিশ বৎসর বয়ঃক্রম পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিখুঁত চরিত্রের পবিত্র জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন। চল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রম পর্যন্ত পরিচিত সকলের কাছে তিনি নির্মল, নিষ্কলঙ্ক, আল আমীন। পঁচিশ বৎসর বয়সে তিনি চল্লিশ বৎসরের এক বিধবাকে বিবাহ করিয়া পঞ্চাশ বৎসর বয়স পর্যন্ত তাঁহার সহিত অতি সুখের দাম্পত্য জীবন কাটান। প্রথমা স্ত্রীর ৬৫ বৎসর বয়সে মৃত্যু হয়। অতঃপর, তিনি সাওদাকে বিবাহ করেন। স্ত্রী সাওদা ও ছিলেন বৃদ্ধা রমণী। মহানবী (সাঃ)-এর অন্য সব বিবাহ যাহা নিয়া ছিদ্রান্বেষীরা সমালোচনা করেন— দ্বিতীয় হিজরী সন হইতে ৭ম হিজরী সনের মধ্যে সম্পাদিত হইয়াছিল। এই কয়েকটি বৎসর মহানবী (সাঃ) সদা-সর্বদা যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁহার জীবন অনবরত সংকটের পর সংকটে আবর্তিত হইতেছিল, ইসলামের ভাগ্য তখন শূন্যে ঝুলিতেছিল। আর অনিশ্চয়তা ছিল তাহার নিত্য সাথী। এমতাবস্থায়, বিপদের পর বিপদ আর অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তার মধ্যে, কোন সুস্থ-মস্তিষ্ক ব্যক্তি ভোগ-বিলাসের উদ্দেশ্য নিয়া বিবাহের পর বিবাহ করিতে থাকিবে, ইহা ভাবাই যায় না। একমাত্র মোহাচ্ছন্ন, ঈর্ষান্ধ ব্যক্তিরাই এইরূপ বিকৃত ধারণা পোষণ করিতে পারে। সপ্তম হিজরীর পরে মহানবী (সাঃ)-এর জীবনে স্বস্তি আসে। জীবনের শেষ তিনটি বৎসর তিনি সারা আরবের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন। আরবের ভাগ্যনিয়ন্তা রূপে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপর তাঁহার পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু এই সুখ-শান্তির সময়ে তিনিতো একটি বিবাহও করেন নাই। ইহাতে কি প্রমাণিত হয় না যে, পূর্ববর্তী বিবাহগুলির পশ্চাতে সৎ, নিষ্ঠাবান ও মহৎ উদ্দেশ্যাবলী নিহিত ছিল? “যে নিজেকে পেশ করিয়াছে নবীর জন্য” বাক্যাংশটি মায়মুনার প্রতি প্রযোজ্য, কেননা মায়মুনাই মহানবী (সাঃ)-এর সহিত নিজের বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। “এই আদেশ কেবল তোমারই জন্য, অন্যান্য মো’মেনদের জন্য নহে” – বাক্যটি দ্বারা বুঝা যায়, এতগুলি বিবাহ এবং এক সাথে সব বিবিকে নিজের কাছে রাখা, মহানবী (সাঃ)-এর জন্য একটি একক সুবিধা ও ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা, যাহা তাহার কর্মকাণ্ডের বহুমুখিতার জন্য তাঁহাকে দেওয়া হইয়াছিল। সূরা নিসার ৪ আয়াতে একজন মুসলমানের পক্ষে চারজনের অতিরিক্ত স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ হইয়া যাওয়ার পরও মহানবী (সাঃ)-কে এই নিষেধের বাহিরে রাখা হয়। মহানবী (সাঃ)-এর নিজের এবং তাঁহার স্ত্রীগণের অতুচ্য আধ্যাত্মিক মর্যাদা এবং অন্যান্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কারণে, এই আয়াতের প্রথমেই মহানবী (সাঃ)-কে সাধারণ মুসলমান হইতে আলাদা ও ব্যতিক্রম হিসাবে ধরা হইয়াছে।