‘খাতাম’ শব্দটি ‘খাতামা’ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ‘খাতামা’ অর্থ হইলঃ সে মোহর মরিল, সে মোহরাঙ্কিত করিল, বস্তুটির ছবি বা ছাপ মারিল। এইগুলি হইল ‘খাতামা’ শব্দের প্রাথমিক অর্থ। ইহার গৌণ অর্থ হয়ঃ সে বিষয় বা বস্তুটির শেষ প্রান্তে পৌঁছিল, বস্তুটি ঢাকিয়া দিল, লিখিত বস্তুকে সংরক্ষণের জন্য লিখনের উপরে কাঁদা বা আঁঠা লেপিয়া দিল বা মোহর মরিয়া রাখিল। ‘খাতাম’ মানে মোহর মারার আংটি, মোহর; অফিসীল বা ষ্ট্যাম্প; চিহ্ন দিবার যন্ত্র; শেষপ্রান্ত; কোন বস্তুর অন্তিমফল। ‘খাতাম’ শব্দ দ্বারা অলঙ্কার; সাজ-সজ্জা; সর্বতোভাবে পূর্ণ বুঝায়। খাতেম, খতম এবং খাতাম প্রায় সমার্থক (লেইন,মুফরাদাত,ফাতহ এবং যুরকানী)। অতএব ‘খাতামান্ নাবীঈন’ – এর অর্থ হইবেঃ নবীগণের মোহর, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ নবী,নবীগণের সৌন্দর্য ও অলঙ্কার। গৌণ অর্থে নবীগণের শেষ অর্থাৎ নবুওয়াতের ও শরীয়াতের কামালিয়াত ও পূর্ণতার দিক দিয়া সর্বশেষ নবী। তবে আরবী ব্যাকরণে খাতাম শব্দটি যাহা ‘ইসমে আলা’র (যন্ত্রবোধক বিশেষ্য) পদে ব্যবহৃত, যখন বহুবচনের দিকে ‘মুযাআফ’ হয়, তখন ইহা কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যেমন হযরত আলী (রাঃ)-কে নবী করীম (সাঃ) ‘খাতামুল আওলিয়া’ (তফসীর সাফী, আয়াত খাতামান নাবীঈন প্রসঙ্গে) এবং হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে ‘খাতামুল মুহাজেরীন’ বলিয়াছেন (কানযুল উম্মাল, ৬ পৃঃ)। মক্কায় থাকাবস্থায় যখন মহানবী(সাঃ)-এর সকল পুত্রই শৈশবে মারা গেলেন তখন শত্রুরা তাঁহাকে ‘আবতার’ (অপুত্রক বা আটকুড়া) বলিয়া বিদ্রুপ করিত এবং মনে করিত যে, তাঁহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পুরুষ না থাকার কারণে তাঁহার প্রবর্তিত ধর্ম শীঘ্রই হউক আর দেরীতেই হউক, নিঃশেষ হইয়া যাইবে (মুহীত)। শত্রুদের এই বিদ্রুপের প্রত্যুত্তরে সূরা কাওসারে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ঘোষণা করা হইল যে, নবী করীম (সাঃ) অপুত্রক নহেন বরং তাঁহার শত্রুরাই অপুত্রক হইয়া যাইবে। সূরা কাওসার অবতীর্ণ হইবার পর প্রাথমিক মুসলমানদের মনে ধারণা জন্মায় যে, মহানবী (সাঃ)-এর এমন পুত্র সন্তান জন্ম নিবে যাহারা দীর্ঘজীবী হইবে। আলোচ্য আয়াত এই ধারণাকে নাকচ করিয়া ঘোষণা করিল যে, মহানবী (সাঃ) কখনও যুবক-পুত্রের (‘রিজাল’ অর্থ পূর্ণবয়স্ক পুরুষ) পিতা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও হইবেন না। দেখিতে যদিও মনে হয় যে, এই আয়াত ও সূরা কাওসারের বক্তব্যের মধ্যে বিপরীত কথা রহিয়াছে, তথাপি এই আয়াতটি আসলে ঐ অনুমিত বৈপরীত্যের কারণে সৃষ্ট সংশয়কে দূরীভূত করিয়াছে। ইহাতে বলা হইয়াছে, মহানবী মুহম্মদ (সাঃ) হইলেন ‘রসূলুল্লাহ্’ (আল্লাহ্র রসূল) যদ্বারা ইহাই বুঝায় যে, তিনি সারা উম্মতের আধ্যাত্মিক পিতা। শুধু তাহাই নহেন, তিনি খাতামুন্নাবীঈনও বটে অর্থাৎ তিনি সকল নবীগণেরও আধ্যাত্মিক পিতা। অতএব, তিনি যখন সকল মো’মেন ও সকল নবীর আধ্যাত্মিক পিতা, তখন তাঁহাকে কিভাবে ‘আবতার’ বলা যায়। ‘খাতামুন্নাবীঈন’ এর অর্থ যদি শেষ নবী করা হয়, যাহার পরে আর কখনও কোন নবী আসিবেন না, তাহা হইলে প্রসঙ্গের সহিত ইহার কোন সঙ্গতি থাকে না এবং খাপছাড়া হইয়া পড়ে।কেননা, অবিশ্বাসীদের বিদ্রুপাত্মক আক্রমণ ইহাই ছিল যে, মহানবী (সাঃ) একজন ‘আবতার’ বা অপুত্রক লোক। খাতামুন্নাবীঈনের অর্থ উপরোক্ত ভাবে করিলে, তাহা এই বিদ্রুপের খণ্ডন না হইয়া, বরং এই বিদ্রুপের শক্তিশালী স্বীকৃতি হইয়া দাঁড়ায়। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, খাতামের উপরোল্লিখিত অর্থগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, ‘খাতামান্নাবীঈন’-এর চারিটি সম্ভাব্য অর্থ এইরূপ দাঁড়ায় যথাঃ (১) হযরত নবী করীম (সাঃ) নবীগণের মোহর অর্থাৎ মহানবী (সাঃ)-এর সত্যায়নের মোহর ব্যতীত কোন নবীর সত্যতা সাব্যস্ত হইতে পারেনা। প্রত্যেক অতীত নবীর নবুওয়াত মহানবী (সাঃ) – এর সত্যায়ন ও সাক্ষ্য দ্বারা সত্য সাব্যস্ত হয় এবং মহানবী (সাঃ)-এর পরে, তাঁহার সত্যিকার অনুসারী ছাড়া কেহ নবুওয়াত লাভ করিতে পারিবেনা। (২) নবী করীম (সাঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাপেক্ষা মহীয়ান ও পূর্ণতম নবী, যিনি সকল নবীর গৌরব, অলঙ্কার স্বরূপ ছিলেন (যুরকানী, শারাহ মাওয়হিব আল্লাদুন্নিয়া)। (৩) মহানবী (সাঃ) ছিলেন শরীয়াত-বাহী নবীগণের শেষ। এই অর্থ করিয়াছেন মুসলমান উম্মতের প্রখ্যাত বুযুর্গান, ওলামা এবং পণ্ডিতগণ, যথা ইবনে আরাবী, শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ, ইমাম আলী কারী, মুজাদ্দিদ আলফে সানী এবং আরও অনেকে। এই ইসলাম-বিশারদ, মহাজ্ঞানী বুযুর্গানে দীন ও ওলী আল্লাহ্গণের মতে, নবী করীম (সাঃ)-এর পরে এমন কোন নবী আসবেন না, যিনি তাঁহার মিল্লাত বা শরীয়াতকে উঠাইয়া দিবেন অথবা তাহার উম্মতের বাহির হইতে হইবেন (ফতুহাত, তাফহিমাত, মকতুবাত এবং ইয়াকুত ওয়াল জাওয়াহির)। মহানবী(সাঃ)-এর প্রতিভাময়ী পত্নী হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, ‘তোমরা তাঁহাকে (সাঃ) ‘খাতামান নাবীঈন’ বল, কিন্তু এই কথা বলিও না যে, তাহার পরে কোন নবী নাই’ (মনসুর)। (৪) মহানবী (সাঃ) এই অর্থেই শেষ নবী ছিলেন যে, নবুওয়াতের গুণাবলী ও সৌন্দর্য সার্বিকভাবে তাঁহার মধ্যে পূর্ণতা পাইয়াছিল এবং একমাত্র তাহারই মাধ্যমে পূর্ণতমভাবে প্রকাশ পাইয়াছিল।আরবীতেসাধারণ ব্যবহারেও, ‘খাতাম’ শব্দটি শ্রেষ্ঠত্বের শেষসীমা বুঝায়। এতদ্ব্যতীত, কুরআন স্পষ্টভাবে বলিয়াছে, নবী করিম (সাঃ)-এর পরেও উম্মতি নবী আসিবেন (৮ঃ৭০, ৭ঃ৩৬)। মহানবী (সাঃ) নিজের মনেও পরবর্তী কালে উম্মতী নবীর আগমন হইবে বলিয়া স্পষ্ট ধারণা রাখিতেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ইব্রাহীম (মহানবী সাঃ-এর পুত্র) যদি জীবিত থাকিত, তবে নিশ্চয়ই নবী হইত (মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয)। তিনি আরও বলিয়াছিলেন, ‘এই উম্মতে আবুবকর সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ মানুষ, যদি কোন নবী হন তিনি ব্যতিরেকে’ (কানযুল উম্মাল)।