২৩৫৭-খ

নবী করীম (সাঃ)-এর ফুফুর কন্যা ছিলেন যয়নাব। এই হিসাবে তিনি ছিলেন পূর্ণরক্তের আরব মহিলা। তিনি ছিলেন গৌরবের অধিকারিণী, মর্যাদাশালিণী মহিলা। ইসলাম বিশ্বকে এমন একটা অভিনব সভ্যতা ও সংস্কৃতি দিতে আসিয়াছিল যেখানে শ্রেণীভেদ, বংশ মর্যাদা, চিরস্থায়ী স্বার্থ ইত্যাদির স্থান রহিল না। সকল মানুষই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র কাছে সমান। এই সুমহান ইসলামী আদর্শকে ভূপৃষ্ঠে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি নিজের পরিবারেই তাহা প্রথমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। তিনি যয়নাবকে যায়েদের কাছে বিবাহ দিতে চাহিলেন। যায়েদ যদিও তখন মুক্ত মানুষ, তথাপি তাহার অতীতের কৃতদাসত্ব অনেকের মনে তখনও জাগরূক ছিল। কৃতদাসত্বের এই চিহ্ন তথা ‘মুক্ত’ ও ‘কৃতদাস’-এর মধ্যকার অসঙ্গত এই ব্যবধান দূর করার জন্যই মহানবী (সাঃ) যয়নবের সহিত যায়েদের বিবাহ দিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যয়নাব এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। নবী করীম (সাঃ)-এর উদ্দেশ্য পূরণ হইল। জাতিভেদ, বর্ণভেদ ও শ্রেণীভেদ উচ্ছেদ করা হইল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এই বিবাহ স্থায়ী হইল না। তবে, এই বিবাহ স্থায়ী না হওয়াতে যায়েদ ও যয়নাবের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার বৈষম্যকে মোটেই দায়ী করা যায় না। কারণ দুইজনের মধ্যে এইরূপ বৈষম্যের কথা কখনও উত্থিত হয় নাই। তবে, দুইজনের চাল-চলন ও মেযাজ-মর্জির মধ্যে মিল ছিল না এবং যায়েদ সর্বদাই নিজেকে হেয় মনে করিতেন যাহা যয়নাবের মনকে পীড়া দিত। এই বিবাহের অকৃতকার্যতায় নবী করীম (সাঃ)-এর মনে সাধারণভাবেই কষ্টের উদ্রেক হইল। কিন্তু ইহাতে আরেকটি উপকার সাধিত হইল। এই আয়াতেরই শেষাংশে বর্ণিত আল্লাহ্‌র এক আদেশে মহানবী (সাঃ) স্বয়ং যয়নাবকে বিবাহ করিয়া আরবদের বহু পুরাতন একটি কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করিয়াছিলেন। কুসংস্কারটি ছিল— পোষ্যপুত্রের পরিত্যক্তা স্ত্রীকে নিজের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা মহা অন্যায় ও পাপ। ফলে, পোষ্যপুত্রকে নিজের ঔরসজাত পুত্রের অধিকার ও স্থান দিয়া লালন-পালন করার রীতি বাতিল হইয়া গেল এবং এইরূপ ধারণাও উঠিয়া গেল। এইরূপে যয়নাবের সহিত যায়েদের বিবাহ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হইল এবং এই বিবাহের অস্থায়ীত্ব আরেকটি মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের উপলক্ষ্যও হইল। ‘আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর’ এই উপদেশ-বাক্যের তাৎপর্য ইহাই যে, যায়েদ যয়নাবকে তালাক দিতে চাহিতেছিলেন। যেহেতু ইসলামের শিক্ষানুযায়ী, তালাক দান আল্লাহ্‌র কাছে একটি ঘৃণ্য কাজ, সেইজন্য মহানবী (সাঃ) যায়েদকে এই কাজ হইতে বিরত রাখিতে চাহিয়াছিলেন। ‘তুমি আল্লাহ্‌র তাক্‌ওয়া অবলম্বন কর’ বাক্যাংশটি যায়েদের প্রতিও আরোপিত হইতে পারে এবং নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতিও আরোপিত হইতে পারে। যায়েদের প্রতি আরোপিত হইলে, ইহার অর্থ দাঁড়াইবে এইরূপঃ যয়নাবের সহিত তাহার বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা ও কারণ যায়েদ লুকাইতে চাহিতেছিলেন। কারণ আল্লাহ্‌র তাক্‌ওয়া অবলম্বন কথাটিতে বুঝা যায়, দোষ যয়নাবের চাইতে যায়েদেরই ছিল বেশী। বাক্যাংশটিকে মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি আরোপ করিলে অর্থ দাঁড়াইবে এইরূপঃ যেহেতু যায়েদের সহিত যয়নাবের বিবাহ তাহার ইচ্ছা ও উদ্যোগে হইয়াছিল, সেজন্য তিনি এই বিবাহ-বিচ্ছেদ দ্বারা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের প্রথম পরীক্ষায় অকৃতকার্য সাব্যস্ত হওয়ায়, দুর্বল বিশ্বাসের লোকেরা বিব্রত ও মানসিক চাঞ্চল্য বোধ করিবে। তুমি মানুষকে ভয় করিতেছিলো -বাক্যটিতে এই কথাই বলা হইয়াছে। মহানবী (সাঃ)-এর সাথে যয়নাবের বিবাহকে কেন্দ্র করিয়া, ইসলামের সমালোচক কোন কোন খৃষ্টান, মিথ্যা অপবাদ ও হীন আক্রমণ রচনা করিয়াছেন। তাহারা বলেন যে, মহানবী (সাঃ) ঘটনাচক্রে যয়নাবকে দেখিতে পাইয়া তাহার সৌন্দর্যে আত্মহারা ও বিমুগ্ধ হইয়া গেলেন। তিনি (সাঃ) যয়নাবকে বিবাহ করিতে চান একথা যায়েদ টের পাইয়া যয়নাবকে তালাক দিতে চাহিলেন। নবী করীম (সাঃ)-এর জীবনের চরম শত্রুগণ যাহাদের চোখের সামনে এই ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল, তাহারা পর্যন্ত তাঁহার (সাঃ) সম্বন্ধে এমন কুৎসিৎ ধারণা পোষণ ও প্রকাশ করিতে সাহস করে নাই, যাহা বহু শতাব্দী পরে এই খৃষ্টান সমালোচকগণ নিজ হইতে আরোপ করিলেন। সম-সাময়িক শত্রুরাও যখন তাঁহার প্রতি এরূপ অপবাদ আবিষ্কার করে নাই, তখন শত শত বৎসর পরে খৃষ্টান সমালোচকদের আরোপিত এই অপবাদ যে একেবারে ভিত্তিহীন ও স্বপরিকল্পিত, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। যয়নাব ছিলেন মহানবী (সাঃ)-এর ফুফাত বোন এবং এই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার কারণে তিনি তাহাকে পর্দা প্রথার নির্দেশপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত বহুবার দেখিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া, মহানবী (সাঃ)-এর পুনঃ পুনঃ ব্যক্ত ইচ্ছার সম্মান রক্ষার্থে যয়নাব যায়েদকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। একথাও প্রকাশিত সত্য যে, যায়েদের সহিত বিবাহের পূর্বে যয়নব ও তাহার ভ্রাতা মহানবী (সাঃ)-এর সহিত যয়নাবের বিবাহের প্রস্তাব নিজেরাই দিয়াছিলেন। যখন যয়নাব অবিবাহিতা অবস্থায় নিজেই নবী করীম (সাঃ)-কে বিবাহ করার ইচ্ছা স্বীয় ভাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করিয়াছিলেন, তখন এমন কি বাধা ছিল যে মুহাম্মদ (সাঃ) তাহা করিলেন না? অতএব এই উদ্ভট কাহিনী যে মহানবী (সাঃ)-এর শত্রুপক্ষীয় সমালোচকদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত তাহা দিবালোকের মত স্পষ্ট। এই কল্প-কাহিনী বিশ্বাস করা মানব-বুদ্ধির অবমাননার শামিল।