পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে যে মূল বক্তব্য রাখা হইয়াছে তাহা এই যে, আমরা যেন এই বিশ্বাসে নিশ্চিতভাবে উপনীত হই যে, আল্লাহ্ মহাপ্রতাপশালী সর্বশক্তিমান, যিনি সব কিছুর সৃষ্টি ও জন্ম-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করিয়া থাকেন। এই আয়াতে বলা হইতেছে যে, যখন মানুষ বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারের অন্ধকারে হাবুডুবু খাইতে থাকে এবং প্রকৃত আল্লাহ্কে ছাড়িয়া নিজের মনগড়া খোদার পূজায় গা ভাসাইয়া দেয় তখন আল্লাহ্ তাহাদের মধ্যে নবী প্রেরণ করিয়া বিভ্রান্ত ও হারানো মেষগুলিকে পথ দেখাইয়া পুনরায় নিজের খোঁয়াড়ে নিয়া আসেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভটা ছিল জাতীয় ও সমাজ জীবনে এক মহা পচনের যুগ, নৈতিক জীবনে তখন ধর্মের প্রভাব একেবারে তিরোহিত হইয়া গিয়াছিল। ধর্ম কেবল অর্থহীন কতকগুলি আচার-অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হইয়া গিয়াছিল। বিশ্বের বড় বড় ধর্মগুলি অনুসারীদের জীবনে সুস্থ প্রভাব ফেলিতে একেবারে অক্ষম হইয়া পড়িল। যরথুস্ত্র, মূসা ও ঈসার প্রজ্বলিত আলোকবর্তিকা মানুষের রক্তে নির্বাপিত হইয়া গেল …….. পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে সভ্যজগত উশৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার দ্বার-প্রান্তে উপনীত হইল। মনে হইল, চার হাজার বৎসর পূর্ব হইতে তিলে তিলে গড়িয়া উঠা সভ্যতা এই বুঝি ভাঙ্গিয়া পড়িল। ….. যে সভ্যতা মহাবৃক্ষের মত শাখা-প্রশাখা ও পল্লব-পুষ্পদারা বিশ্বকে ছাইয়া ফেলিয়াছিল, যে সভ্যতার স্পর্শ কারু-কার্য, চারুকলা, বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে সুবর্ণ ফলের মত সাজাইয়া তুলিয়াছিল তাহা এখন টলটলায়মান হইয়া গেল। সেই বৃক্ষের কাণ্ডগুলির ভক্তি-ভালবাসা ও শ্রদ্ধা-আকর্ষণী শক্তি একেবারে নিঃশেষ হইয়া গেল এবং দেখিতে দেখিতে পচিয়া গেল’ (ইমোশন এ্যাজ দি বেসিস অব সিভিলাইজেশন এবং স্পিরিট অব ইসলাম)। এই ছিল মানুষের অবস্থা যখন বিশ্ব-মানবতার পরম শিক্ষক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিশ্বের ধর্ম-মঞ্চে আবির্ভূত হইলেন। তাঁহার কাছে পূর্ণতম ও সর্বশেষ ধর্মীয় বিধান কুরআন শরীফের আকারে অবতীর্ণ হইল। পূর্ণতম বিধান বা শরীয়াত তখনই নাযেল হওয়ার উপযুক্ত ও যুক্তিযুক্ত সময় ছিল যখন সর্বপ্রকার পাপরাশির অধিকাংশই কোন না কোনরূপে পৃথিবীর বুকে আত্ম প্রকাশ করিয়াছিল। ‘স্থলে-জলে’ শব্দদ্বয় দ্বারা যথাক্রমে বুঝাইতে পারেঃ (ক) স্থল দ্বারা ঐ জাতিগুলি বুঝায় যাহারা কেবল যুক্তি ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করিয়া স্বীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিয়াছিল এবং জল দ্বারা ঐ জাতিগুলি বুঝায় যাহারা ঐশী-বাণীর উপর ভিত্তি করিয়া স্বীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়াছিল, (খ) যাহারা মূল ভূখণ্ডগুলিতে বাস করে এবং যাহারা দ্বীপগুলিতে বাস করে। মোট কথা জলে-স্থলে’ বলিতে এই আয়াতে বিশ্বের সকল জাতিকেই বুঝাইয়াছে— তাহারা সকলেই রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং সর্বোপরি নৈতিকভাবে চরম অধঃপতনে নিপতিত হইয়াছিল।