২২৭১

এই আয়াত ও পূর্ববর্তী দুইটি আয়াতের প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য বুঝিতে হইলে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে আরবদেশ ও আশপাশের দুইটি বৃহৎ সাম্রাজের— তথা পারশ্য সাম্রাজ্য ও রোম-সাম্রাজ্যের— রাজনৈতিক অবস্থাবলীর দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ প্রয়োজন। এই দুইটি বিশাল সাম্রাজ্য পরস্পর যুদ্ধরত ছিল। ৬০২ খৃষ্টাব্দে রোম সম্রাটের বন্ধু ও হিতৈষী মোরিস পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরূ ফোকাসের হাতে মারা গেলে যুদ্ধের সূচনা হয়। সূচনা পর্বে, পারস্য সম্রাটের জয় জয়কার শুরু হইয়া গেল। প্রায় বিশ বৎসর ধরিয়া পারস্য বাহিনী রোমান সাম্রাজ্যকে তছনছ করিতে লাগিল। এমনটি পূর্বে আর কখনও ঘটে নাই। পারস্য-সেনারা সিরিয়া ও এশিয়া মাইনর লুণ্ঠিত ও পদদলিত করিল এবং ৬০৮ খৃষ্টাব্দে চালসেডন পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া গেল। ৬১৩ খৃষ্টাব্দে তাহারা দামেস্ক দখল করিয়া লইল। এমন কি দামেস্ক এলাকার আশে পাশের দেশগুলিতে ঐ সময় পর্যন্ত যে ভূমিতে পারস্য সন্তান কখনও পা রাখিতেও সাহস পায় নাই, সে সব রোমীয় দেশগুলিও পারসিকদের পদানত হইল। অতঃপর ৬১৪ খৃষ্টাব্দে জেরুযালেমও পারস্য-সম্রাটের করতলগত হইল। সমগ্র খৃষ্টান বিশ্ব ভীত-বিহ্বল ও হতভম্ব হইয়া খবর শুনিল যে, পারসিকেরা খৃষ্টের ক্রুশকাঠ সহ পেট্রিয়ার্ককে (সর্ব্বেচ্চ খৃষ্টান ধর্মযাজক)- ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। খৃষ্টধর্ম অপমানিত ও ভুলুণ্ঠিত হইল। জেরূযালেম দখল করিয়াও পারস্য-বাহিনী থামিল না। তাহারা মিশর জয় করিল, এশিয়া মাইনর পুনর্বার লুণ্ঠন করিল এবং অতঃপর কনষ্টান্টিনোপলের সিংহদ্বারের কাছে আসিয়া হানা দিল। রোমীয়রা আত্ম-কলহে বিভক্ত থাকার ফলে শত্রুকে প্রতিহত করার উদ্যোগ নিতে সক্ষম ছিল না। সম্রাট হেরাক্লিয়াসের অসহায়তা ও অপমান এতই হীনতম পর্যায়ে গিয়া পৌঁছিল যে, ‘সম্রাট’ (খসরূ) তাহাকে তাহার সিংহাসনের পায়ের সহিত বাঁধা অবস্থায় উপস্থিত করার হুকুম দিলেন। এমন কি ক্রুশবিদ্ধ খোদার বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া সূর্যের উপাসনা অবলম্বন না করা পর্যন্ত তাহাকে রেহাই দেওয়া হইবে না বলিয়া শাসাইয়া ছিলেন। (হিষ্টোরিয়ানস্ হিস্ট্রি অব দি ওয়ার্লড় ৭ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৯, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ৯৪-৯৫ এবং এনসাইক রট ‘খসরূ’ ২য় ও হেরাক্লিয়াসৃ’ বিষয়ে)। তখনকার এই অস্থির অবস্থা মুসলমানদের মনকেও কষ্ট দিল। কেননা রোমীয়দের সাথে মুসলমানদের কতকটা ধর্মীয় মিল রহিয়াছে, যেহেতু তাহারা কিতাবধারী (আহলে কিতাব)। কিন্তু মক্কার কুরাইশগণ, যাহারা পারস্যবাসীরই মত মূর্তি-উপাসক ছিল, খৃষ্টান সেনাবাহিনীর পতনের মধ্যে আনন্দ লাভ করতঃ মনে মনে ভাবিতেছিল যে, উদীয়মান ইসলামও খৃষ্টানদের মতই অচিরে বিনষ্ট ও পদদলিত হইবে। রোমীয় বাহিনী এইভাবে পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে পরেই, হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ৬১৬ খৃষ্টাব্দে একটি ঐশী-বাণী অবতীর্ণ হইল যাহা আলোচ্য আয়াত ও তৎপূর্ববর্তী দুইটি আয়াতের বিষয়-বস্তু। এই আয়াতগুলির দ্বিমুখী তাৎপর্য রহিয়াছে। এই আয়াতগুলির মধ্যে সম্পূর্ণ অভাবনীয়, অচিন্তনীয় ও বিরূপ অবস্থার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইতেছে যে, আগামীতে মাত্র ৮/৯ বৎসরের মধ্যে (বিয্‌’উন অর্থ ৩ থেকে ৯ বৎসর) চলতি অবস্থা একেবারেই উল্টিয়া যাইবে। বিজয়ী পারস্য-বাহিনী এই পর্যুদস্ত, পরাজিত ও পদদলিত রোমীয়দের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করিবে। ভবিষ্যদ্বাণীটির গভীরতর অপর তাৎপর্য হইল, এই অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের ভিত্তিমূল রচিত হইয়া যাইবে এবং সংশয়, অন্ধকার ও অবিশ্বাসের শক্তিসমূহের পরাজয় ও বিনাশের করুণ বাঁশরী বাজিয়া উঠিবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি মানুষের কল্পিত হিসাবের সম্পূর্ণ বিপরীতে মানব-বুদ্ধিকে হতচকিত করিয়া কল্পনাতীত অবস্থায় পরিপূর্ণ হইল। ঐতিহাসিক গীবন বলেন, “পারস্য বাহিনীর বিজয়ের মধ্যে তিনি (মুহাম্মদ-সাঃ) কী নির্দ্বিধায় ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করিলেন যে, বেশী সংখ্যক বছর গত হইবে না, বিজয় রোমীয়দের পতাকায় প্রত্যাবর্তন করিবে। …… যে সময়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হইয়াছিল, তখন ইহার পূর্ণ হওয়ার দূরতম অবস্থাও বিদ্যমান ছিল না। কেননা, বারোটি বৎসর যাবত হেরাক্লিয়াসের ক্রমাগত পরাজয় ও বিপর্যয় ইহা ঘোষণা করিয়া আসিতেছিল যে, তাহার সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি অত্যাসন্ন।” (রাইজ, ডিক্লাইন এণ্ড ফল অব দি রোমান ইম্পায়ার—বাই গীবন, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৭৪)। বহু বছরের পরাজয়ের গ্লানির পর ৬২২ খৃষ্টাব্দে হেরাক্লিয়াস পারস্য-বাহিনীর মোকাবিলায় নব-উদ্যোগে মাঠে নামিলেন। ইহা ছিল মহানবী (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের বৎসর। ৬২৪ খৃষ্টাব্দে হেরাক্লিয়াস উত্তর মেডিয়ায় অগ্রসর হইলেন এবং সেখানকার ‘গাওজাক’ এর সুবৃহৎ অগ্নি উপাসনালয় ভুলুন্ঠিত করিয়া জেরুযালেম ধ্বসের প্রতিশোধ গ্রহণ করিলেন। আলোচ্য আয়াতে উল্লিখিত ঠিক ৯ম বৎসরেই এই ঘটনা সংঘটিত হইল। ভবিষ্যদ্বাণীটিকে অধিকতর শক্তিশালী ও তাৎপর্যমণ্ডিত করিয়া আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটিল যে, ঐ বৎসরই মক্কার গৌরবশালী কোরায়শগণের শৌর্যবীর্য অল্প সংখ্যক মুসলমানের হাতে বদরের যুদ্ধে চিরতরে ভুলুণ্ঠিত হইল। ইহাতে বাইবেলে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী—‘কেদারের শৌর্য ভূলুণ্ঠিত হইবে’— পূর্ণ হইল। (যিশাইয় – ২১ঃ১৬-১৭)। অতঃপর ৬২৭ খৃষ্টাব্দে হেরাক্লিয়াস নীনেভায় পারস্য-সৈন্যকে পরাভূত করিয়া সেসিফনের দিকে অগ্রসর হইল৷ খসরূ (পারস্য-সম্রাট) তাহার অতি প্রিয় প্রাসাদ ‘দস্তগর্দ (বাগদাদের কাছে) হইতে পলায়ন করিল। এই অবস্থায় অপমানজনক অজ্ঞাত জীবন অতিবাহিত করার পর ৬২৮ খৃষ্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারী স্বীয় পুত্র সিরোসের হাতে নিহত হয়। এইভাবে যে পারস্য সাম্রাজ্য কয়েক বৎসর পূর্বেও দৃশ্যতঃ শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ধারণ করিয়াছিল তাহা নৈরাশ্যজনক অরাজকতার শিকার হইয়া গেল। (এনসাই বৃট)। এই আলোচ্য আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা ও উজ্জ্বলতা এতই কল্পনাতীত যে, ঈর্ষাপরায়ণ খৃষ্টান লিখকগণ ইহার অপব্যাখ্যা করিতেও চেষ্টার কম করেন নাই। রডওয়েল বলেন যে, এই আয়াতের শব্দগুলিতে জের-জবর-পেশ কিছুই দেওয়া ছিল না। তাই শব্দগুলিকে যে কোন ভাবে উচ্চারণ করা যাইত। ‘সাইয়াগলেবুন পড়িলে অর্থ দাঁড়াইত তাহারা বিজয়ী হইবে;’ আর সাইউগলাবুন উচ্চারণ করিলে অর্থ দাঁড়াইত ‘তাহারা পরাজিত হইবে’। তিনি আরো বলেন, এই দ্ব্যর্থবোধকতা ইচ্ছাকৃত ছিল। এই পাদ্রী ভদ্রলোক জানিয়াও না জানার ভান করিয়াছেন। ইহাত জানা কথা যে,অবতীর্ণ হবার পরে এই আয়াতগুলি পাঁচবারের দৈনিক নামাযে শত শত বার পঠিত ও উচ্চারিত হইয়াছিল। তাই উচ্চারণ ও পঠন অনির্ধারিত থাকার প্রশ্নই উঠে না। মিঃ হুয়েরী আজব কথা শুনাইয়া নতুনভাবে গোপন ঈর্ষা প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি যুক্তি উত্থাপন করিয়া বলিয়াছেন, ‘আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলিও তো প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পূর্বাভাষ দিয়া থাকে। হুয়েরী সাহেবদের এইরূপ ব্যর্থ প্রয়াস দ্বারা এই ভবিষ্যদ্বাণীর অপব্যাখ্যা ও খর্বতা সাধন যে কোন মতেই সম্ভব নয়, গীবনের উপরোক্ত ঐতিহাসিক উক্তিসমূহই উহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।