২০৪৪

যেহেতু ইসলামী পর্দা সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানের অভাব এবং অতি মাত্রায় ভুল বোঝাবুঝি (এমনকি মুসলমানগণের মধ্যেও) বিরাজ করে, সেই কারণে বহু বিতর্কিত এই বিষয়টির উপর এস্থলে কিছু বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। নিম্নে উল্লেখিত আয়াতগুলিতে পর্দা সম্পর্কিত বিষয়ে আলাচিত হইয়াছেঃ (১) “এবং তুমি মো’মেন নারীদিগকে বল তাহারাও যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে হিফাযত করে …… আয়াত শেষ পর্যন্ত (২৪ঃ৩২ অর্থাৎ তফসীরাধীন আয়াত)। (২) “হে নবী! তুমি তোমার পত্নীগণকে, তোমার কন্যাগণকে এবং মো’মেনগণের পত্নীগণকে বল, যেন তাহারা তাহাদের চাদরকে নিজেদের উপর (মাথা হইতে টানিয়া বক্ষঃদেশ) পর্যন্ত ঝুলাইয়া লয়, এতদ্বারা তাহাদের পরিচয় অত্যন্ত সহজ হইবে এবং তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া হইবে না” (৩৩ঃ৬০)। এই আয়াতে (৩৩ঃ৬০) আরবী শব্দ ‘জালাবীব্‌’ এক বচনে ‘জিলবাব’ যাহার অর্থ বহিরাবরণ বা চাদর (লেইন)। (৩) “হে নবী(সাঃ)-এর পত্নীগণ! তোমরা কোন সাধারণ নারীগণের মত নহ যদি তোমরা তাক্‌ওয়া অবলম্বন করিয়া চল, অতএব তোমরা চাপা মিহিসূরে কথা বলিও না, নতুবা যাহার অন্তরে ব্যাধি আছে সে প্রলুদ্ধ হইতে পারে এবং সদা ন্যায়-সঙ্গত কথা বলিও। এবং তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করিও এবং পূর্বতন অজ্ঞযুগের পদ্ধতিতে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করিও না,………….(৩৩ঃ৩৩-৩৪)। (৮) “হে যাহারা ঈমান আনিয়াছ! তোমাদের ডান হাত যাহাদের অধিকারী হইয়াছে তাহারা এবং তোমাদের মধ্য হইতে যাহারা এখনও প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছায় নাই তাহারা যেন তিন সময়ে তোমাদের নিকট হইতে অনুমতি গ্রহণ করে (এবং তোমাদের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে), ফজরের নামাযের পূর্বে এবং দ্বিপ্রহরের সময় যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খোল এবং ইশার নামাযের পর………….. (২৪ঃ৫৯)। উপরোক্ত চারটি আয়াত হইতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ উদ্ভূত হয়ঃ (ক) মুসলমান নারী যখন বাহিরে যায় তাহাদিগের ‘জিলবাব’ অর্থাৎ বহিরাবরণ পরিধান করা আবশ্যক, যদ্বারা মাথা হইতে বক্ষঃদেশ পর্যন্ত সমস্ত দেহ ঢাকিয়া যায়। ইহাই কুরআন মজীদে বর্ণিত ‘ইউদ্‌নীনা আলায়হিন্না মিন জালাবীবিহিন্না (৩৩ঃ৬০)। বাহ্যিক দেহাবরণ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হইতেছে একজন মুসলমান স্ত্রীলোককে সন্দেহজনক চরিত্রের লোকের জলন্ত দৃষ্টি বা উত্ত্যক্ত করা অথবা অন্য কোন ঝামেলাপূর্ণ মানসিক যন্ত্রণার হাত হইতে রক্ষা করা। (খ) মুসলমান পুরুষ এবং নারী পরস্পরের সহিত সাক্ষাতে তাহাদের দৃষ্টি সংযত রাখবে। (গ) তৃতীয় আদেশটি, আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি প্রযোজ্য তবু ইহা কুরআন মজীদের রীতি অনুযায়ী অন্যান্য মুসলমান স্ত্রীলোকদিগকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ‘এবং তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করিও’ (৩৩ঃ৩৪) কথাগুলির পরোক্ষ প্রকাশ এই যে, প্রয়োজনে স্ত্রীলোকেরা ঘরের বাহিরে যাইতে পারে, কিন্তু পক্ষান্তরে তাহাদের প্রধান ও মুখ্য কর্মক্ষেত্র হইল গৃহাভ্যন্তর। (ঘ) উল্লেখিত তিনটি সময়ে, এমনকি শিশুদেরও তাহাদের পিতামাতার একান্ত কক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ, পারিবারিক ভূত্য বা কৃতদাসীরও মালিকের শয়ন কক্ষে উল্লেখিত নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশের অনুমতি নাই। প্রথম আদেশ স্ত্রীলোকদের বাহিরে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাড়ীর বাহিরে যাওয়ার সময় তাহারা দেহের বহিরাবরণ (বোরকা বা চাদর ইত্যাদি) পরিধান করিবে যাহাতে সমস্ত শরীর ঢাকিয়া যায়। দ্বিতীয় আদেশ ‘পর্দা’ সম্পর্কে বুনিয়াদিভাবে ঘরের চারি দেওয়ালের মধ্যে যখন নিকট পুরুষ আত্মীয়গণ বার বার আসা যাওয়া করে। সেই ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারীকে তাহাদের দৃষ্টি সংযত রাখা আবশ্যক এবং নারীর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন যাহাতে তাহাদের ‘যিনাত’ অর্থাৎ দেহের পোশাকের ও অলংকারের সৌন্দর্য প্রকাশ করা না হয়। সেই সময় তাহাদিগকে ‘জিল্‌বাব’ (বোরকা ইত্যাদি) পরিধান করা আবশ্যকীয় নহে। কারণ খুবই নিকট স্বগোত্রীর লোকজনের অবাধ এবং সচরাচর গমনাগমনের মধ্যে এইরূপ করা বিরক্তিকর এবং অসম্ভবও। বর্ণনার প্রসঙ্গে ইহাই মনে হয় যে, এই হুকুম বাসগৃহের অভ্যন্তরের ‘পর্দা’ সম্পর্কিত, কারণ তফসীরাধীন আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিগণ নিকটতম আত্মীয়, যাহারা তাহাদের জ্ঞাতি লোকদের বাড়ীতে সাধারণতঃ যাওয়া আসা করে। নিকট আত্মীয় ছাড়া ইহাতে চার প্রকার লোকের কথা বলা হইয়াছে, যথা শালীন মহিলা, বৃদ্ধ চাকর, কৃতদাসী এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক। তাহাদের বিশেষ উল্লেখ এই অনুমানের উপরেই অতিরিক্ত জোর দেয় যে, আয়াতের নির্দেশ বাড়ীর চার দেয়ালের ভিতরের পর্দা সম্পর্কযুক্ত। প্রথমোক্ত আদেশ বাড়ীর বাহিরের ‘পর্দা’ বুঝায় এবং দ্বিতীয় আদেশ মূলতঃ অভ্যন্তরের পর্দা বুঝায়। ইহা সংশ্লিষ্ট আয়াত অর্থাৎ ৩৩ঃ৬০ এবং তফসীরাধীন আয়াতসমূহে দুই প্রকার পর্দার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহারের দ্বারা সুস্পষ্ট করিয়া দিয়াছে। কার্যতঃ ৩৩ঃ৬০ আয়াত অনুযায়ী স্ত্রীলোক বাড়ীর বাহির গেলে তাহাকে জিলবাব (বহিরাবরণ) পরিধান করিতে হয়, কিন্তু পক্ষান্তরে গৃহাভ্যন্তরে যখন নিকটাত্মীয়রা আসা-যাওয়া করে তখন তাহাকে ‘খিমার’ (মাথার ঘোমটা) ব্যবহার করিতে হয়। তদুপরি ৩৩ঃ৬০ আয়াতে যেখানে ব্যবহৃত শব্দসমূহ হইতেছে ‘ইউদ্‌নীনা আলায়হিন্না মিন যালাবিবিহিন্না’ অর্থাৎ তাহাদের বহিরাবরণ আলম্বিত করিতে বলা হইয়াছে (জিলবাব্‌ এবং ইউদ্‌নীন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন ৩৩ঃ৬০) এখানে তফসীরাধীন আয়াতে বলা হইয়াছে ‘ইয়ায্‌রিবনা বিখুমু রিহিন্না আলা ‘জুইয়ুবিহিন্না, অর্থাৎ তাহাদের উড়নাগুলিকে বক্ষঃদেশের উপর দিয়া প্রলম্বিত করিতে হইবে। ইহা স্পষ্ট যে, প্রথমোক্ত ব্যাপারে যখন পোশাক, মাথা, মুখমণ্ডল ও বক্ষঃদেশ ঢাকিয়া দিবে, তখন দ্বিতীয়টিতে কেবল মাথা ও বক্ষঃদেশ ঢাকা পড়িবে এবং মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখিতে পারিবে। আলোচনা প্রসঙ্গে ইহা উল্লেখ্য যে, যেমন উপরে বর্ণিত হইয়াছে যে, বাহিরে যাওয়ার সময় একজন মহিলাকে যে ধরণের লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরিধান করা আবশ্যক যাহা তাহার সমস্ত শরীর ঢাকিয়া রাখিবে, উহার গঠন এবং আকার-আকৃতি মুসলমান সমাজের রীতি, অভ্যাস, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্ন রূপ হইবে। গৃহাভ্যন্তরে ‘পর্দা’ সম্পর্কিত নির্দেশ দোকান-পাট, মাঠ-ঘাট ইত্যাদির বেলায়ও প্রযোজ্য হইবে। যেখানে মুসলিম সমাজের কোন শ্রেণীর নারীদেরকে নিজেদের জীবিকা অর্জনের কাজ করিতে হয়, সেই ক্ষেত্রে একজন স্ত্রীলোককে মুখ ঢাকিবার প্রয়োজন হইবে না। সে কেবল নিজের দৃষ্টি সংযত রাখবে এবং তাহার ‘যীনাত’ অর্থাৎ দেহের গহনাদি ও অন্যান্য তৃতীয় নির্দেশ মতে অপরিচিত পুরুষের সহিত কথা বলার সময় নারীর পক্ষে গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করা আবশ্যক এবং তাহাদের জন্য ইহাই আবশ্যক যে, তাহারা নিজ জাতির হিত সাধনে এবং গৃহস্থালী বিষয়ের ব্যবস্থাপনায় এবং সন্তান পালন এবং তদসম্বন্ধযুক্ত বিষয়াদির উপর নজর রাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কর্তব্যের প্রতি পূর্ণ মনযোগ দিবে। চতুর্থ হুকুম স্বামী এবং স্ত্রীকে নির্দেশ দান করে যে, তাহাদের শয়নকক্ষ, যতদূর সম্ভব, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদিগের নিকট হইতে পৃথক রাখা, যেখানে ৫৯ আয়াতে বর্ণিত সময়ে, এমনকি নাবালেগ ছেলেদেরও প্রবেশের অনুমতি নাই। তফসীরাধীন আয়াতে ব্যবহৃত ‘যীনাত’ শব্দ স্বাভাবিক এবং কৃত্রিম উভয় সৌন্দর্যকে অন্তর্ভুক্ত করে—দৈহিক সৌন্দর্য, পোশাক ও অলংকারের সৌন্দর্য। ‘উহা ব্যতিরেকে যাহা স্বতঃই প্রকাশ পায়’ উক্তিটি ঐ সমস্ত বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে যাহা একজন মহিলার পক্ষে ঢাকিয়া রাখা সম্ভব নহে, যেমন তাহার কণ্ঠস্বর, তাহার চলনভঙ্গি অথবা তাহার দৈহিক উচ্চতা এবং তাহার শরীরের অংশ বিশেষও, যাহা তাহার সামাজিক পদমর্যাদা,পারিবারিক ঐতিহ্য, তাহার পেশা ও সমাজের রীতি-নীতি অনুযায়ী তাহাকে খোলা রাখিতে হয়। দেহের কোন কোন অংশ উন্মুক্ত রাখার যে অনুমতি তাহা বিশেষ অবস্থা সাপেক্ষ। অতএব তাহারা যেন নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে কথাগুলি সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং বিভিন্ন অংশের স্ত্রীলোকগণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব প্রকাশক এবং জাতির প্রথা ও জীবন-যাত্রার প্রণালী এবং পেশার পরিবর্তনের সঙ্গে ইহার অর্থেও পরিবর্তন ঘটবে। ‘এবং তাহাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্য যে, তাহারা পা দিয়া আঘাত না করে’ (২৪ঃ৩২) উক্তিটি প্রতিপন্ন করে যে, জনসাধারণ্যে প্রকাশ্য নাচ, যাহা কোন কোন দেশে অত্যধিক প্রচলিত, তাহার অনুমতি ইসলাম কোন মতেই দেয় না। ইহা হইল ‘পর্দা’ সম্বন্ধে ইসলামী ধারণা। এই ধারণা মতে মুসলমান নারী তাহার যুক্তি-সম্মত প্রয়োজনে বাহিরে যাইতে পারে, কিন্তু তাহাদের প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য তাহাদের বাড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যাহা বাহিরে পুরুষের কাজের ন্যায় প্রয়োজনীয় এবং গুরত্বপূর্ণ। নারী যদি পুরুষের পেশা গ্রহণ করে তাহা হইলে তাহারা প্রকৃতিকে অস্বীকার করে এবং প্রকৃতি কোন প্রকারেই ইহার বিধান লংঘন করিতে দেয় না।