২০৪

এই আয়াতে সাধারণ আইনের একটি অত্যাবশ্যকীয় নীতি বিধৃত রহিয়াছে। তাহা এই যে, মানুষ সকলেই সমান। অতএব, কোনও প্রকার বৈষম্য ব্যতিরেকে প্রত্যেক দোষী ব্যক্তিকেই তাহার দোষের অনুপাতে শাস্তি দিতে হইবে। অবশ্য, যাহার বিরুদ্ধে দোষ করা হইয়াছে সে যদি ক্ষমা করে, কিংবা নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন যদি ক্ষমা করে এবং ঐ রূপ ক্ষমা করা যদি অবস্থার প্রেক্ষিতে সমাজের জন্য শুভ ও মঙ্গল-জনক হইবে বলিয়া মনে করা হয়, কেবল তখনই দোষী ব্যক্তিকে ক্ষমা করা যাইতে পারে।

‘তোমাদের জন্য আইন করা হইল’ কথাগুলি দ্বারা বুঝা যায়, প্রতিশোধ-গ্রহণ বা প্রতিকার-বিধান করা বাধ্যতা-মূলক (ফরয)। অপরাধী ব্যক্তির আইনানুগ শাস্তিবিধান না করা ঐশী নির্দেশের পরিপন্থী। ইহা ঐশী-বিধানকে অমান্য করার শামিল। ইহা মনে করা ঠিক হইবে না যে, হত্যাকারীকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আত্মীয়দের উপরই ন্যস্ত। কেননা, “তোমাদের উপর ন্যস্ত” (আলাইকুম) কথাটি হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, এই দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের উপর ন্যাস্ত। তবে, আত্মীয়কে অবশ্য ক্ষমা করার অধিকার দেওয়া হইয়াছে। একদিকে যেমন কর্তৃপক্ষ আইনানুযায়ী অপরাধীকে শাস্তিদানে বাধ্য এবং নিজ গুণে ক্ষমা করিতে অক্ষম, তেমনি অন্যদিকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা নিজের হাতে আইন লইয়া নিজেরাই অপরাধীর শাস্তি দিতে পারেন না। শান্তি-প্রদানের ক্ষেত্রে এই আয়াতে অপরাধীদের মধ্যে কোনই তারতম্য করে নাই। বাক্যটি সর্বসাধারণকে লক্ষ্য করিয়া ব্যাবহৃত হইয়াছে, সকল হত্যাকারীকেই এক পাল্লায় ওজন করা হইয়াছে। হত্যাকারীর অবস্থান, মর্যাদা কিংবা ধর্মকে বিবেচনায় আনা হয় নাই। জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং সামাজিক প্রতিপত্তি ও পদ মর্যাদা নির্বিশেষে হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হইবে। তবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা তাহাকে ক্ষমা করিতে পারেন। এই বিষয়ে বর্ণিত মহানবী (সাঃ)-এর হাদীসগুলি সুস্পষ্ট (ইবনে মাজাহ্‌ঃ মাবুদ্‌ দিয়াৎ)। রসূলে পাক (সাঃ)-এর সাহাবীগণ (রাঃ) এই বিষয়ে একমত যে, যুদ্ধহীন অবস্থায় একজন অমুসলিমকে বা অবিশ্বাসীকে হত্যা করিলে, হত্যাকারী মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হইবে (তাবারী-৪৪ খণ্ড) রসূলে করীম (সাঃ) শান্তির অবস্থায়, একজন অমুসলমানকে হত্যা করার জন্য, একজন মুসলমান হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ স্বয়ং দিয়াছিলেন (দার কুৎনী)। “স্বাধীন ব্যক্তির জন্য স্বাধীন ব্যক্তি, কৃতদাসের জন্য কৃতদাস, স্ত্রীলোকের জন্য স্ত্রীলোক” এই কথাগুলি দ্বারা ইহা বুঝায় না যে, একজন কৃতদাসের হত্যার জন্য হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইবে না কিংবা একজন পুরুষকে হত্যার জন্য হত্যাকারিণী স্ত্রীলোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইবে না, ইত্যাদি। ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা কিংবা স্ত্রী-পুরুষ বিবেচনা, কোনও মতেই এই আইনের প্রয়োগকে ব্যাহত করিতে পারে না। তবে, “স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির জন্য……. ” একটি বিশেষ ধরণের প্রচলিত উক্তি। এইরূপ অভিব্যক্তির আশ্রয় এই কারণে গ্রহণ করা হইয়াছে, যাহাতে আরবদের একটা সুপরিচিত সামাজিক রীতিকে স্মরণ করাইয়া দিয়া উহার মূলোৎপাটন করা লক্ষ্য হিসাবে নির্দিষ্ট হইয়া যায়। রীতিটি এই ছিল যে, হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সামাজিক মর্যাদা, ইত্যাদি বিবেচনা করিয়া, শাস্তির কথা ভাবা হইত অর্থাৎ মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ করিয়া, সেই ভেদাভেদ অনুযায়ী অপরাধের পরিমাণেও ভেদাভেদ এবং তারতম্য করা হইত এবং একই অপরাধের জন্য, ভিন্ন জনের ক্ষেত্রে ভিন্ন-ভিন্ন পরিমাপে শাস্তি প্রয়োগ করা হইত। আরও একটি অন্যায় প্রথা এই ছিল যে, হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তির বিনিময়ে তাহার কৃতদাসকে হত্যা করা হইত। এই আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশ ঐসব কুপ্রথাকে চিরতরে বিলোপ করার জন্য প্রণয়ন করা হইয়াছে। বস্তুতঃ, প্রতিকারের নির্দেশটি একটি বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই বাক্যটি হইল, নিহতের পক্ষে ন্যায়-ভিত্তিক প্রতিশোধ গ্রহণ তোমাদের জন্য বাধ্যতামূলক কর্তব্য বলিয়া নির্ধারণ করা হইল, এই বাক্যটি স্বয়ং সম্পূর্ণ, পূর্ণ অর্থবহ স্বতন্ত্র বাক্য। পরবর্তী কথাটি “স্বাধীন ব্যক্তির জন্য স্বাধীন ব্যক্তি, কৃতদাসের জন্য কৃতদাস এবং স্ত্রীলোকের জন্য স্ত্রীলোক” অতিরিক্ত সংযোজন, যাহা নির্ধারিত আইনের অংশ নহে। ইহা আরবদের পূর্বোল্লিখিত রীতিনীতির খণ্ডনের উদ্দেশ্যে এবং তাহার অযৌক্তিকতা প্রকাশের জন্য সংযোজিত হইয়াছে এবং তিনটি উদাহরণ দিয়া বুঝানো হইয়াছে, আইনকে কিভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে। আরবী ব্যাকরণে এইরূপ প্রকাশ ভঙ্গীকে জুম্‌লা ইস্তিনাফিয়া বলা হয় এবং ইহা কৌশলগত ভাবে পূর্বোল্লিখিত বাক্যে নিহিত কোনও প্রশ্নের জওয়াব-স্বরূপ হইয়া থাকে এবং ইহার পূর্বে কোনও সংযোগ-অব্যয় বসে না। এইরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাক্যটিতে যে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া হয়, তাহা প্রায়ই উহ্য থাকে, প্রকাশিত থাকেনা (মুখতাসার)। আঁ-হযরত (সাঃ) বলিয়াছেন “যে ব্যক্তি তাহার কৃতদাসকে হত্যা করিবে তাহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইবে” (ইবনে মাজাহ)। অন্যত্র তিনি বলিয়াছেন “মুসলমান সকলের রক্তই এক প্রকারের, প্রতিশোধ গ্রহণ আইনে ইহাতে তারতম্য করা চলিবে না” (নিসাই)।