ইসলামী শরীয়াতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নির্ণয়কারী নিয়মাবলীর মধ্যে নৈতিক গুণরূপে সতীত্ব ও সাধুতা অতি উচ্চ মার্গের গুণ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। ইহাকে রক্ষা করার ব্যাপক আদেশ-নিষেধ এই সূরাতে প্রবতির্ত হইয়াছে। এই নিয়মের সামান্যতম লংঘন ইসলামের দৃষ্টিতে চরমভাবে অননুমোদিত।সতীত্ব সম্বন্ধে ইসলামের অতি সূক্ষ্ম উপলব্ধির বিষয় এই স্থলে ব্যক্ত হইয়াছে যাহা উভয় অবস্থায় ব্যভিচারের জন্য নির্ধারিত শাস্তির মধ্যে প্রতিফলিত হইয়াছে। শাস্তি একশত বেত্রাঘাত—অপরাধী বিবাহিত হউক অথবা অবিবাহিত, একজন বিবাহিত এবং অপরজন অবিবাহিত হউক ইহাতে কোন পার্থক্য নাই। এই আয়াত মতে ব্যভিচারের শাস্তি হইতেছে নির্ধারিত বেত্রাঘাত, প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা নহে। কুরআনে কোথাও ব্যভিচারের জন্য প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ নাই। এমন কি ব্যভিচার অপেক্ষা অধিকতর জঘন্য অপরাধ যাহা পরিকল্পিত হত্যা, ডাকাতি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং দেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্যও ইসলাম ধর্ম অপরিহার্যভাবে বা শর্তহীনভাবে হত্যার শাস্তি নির্ধারণ করে নাই। যদিও এই সমস্ত অপরাধের চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তথাপি হত্যার রক্ত-পণ বা খেসারত আদায় (২ঃ১৭৯) এবং অন্যান্য অপরাধগুলির জন্য কারাবাস অথবা নির্বাসন (৫ঃ৩৩-৩৪) বিকল্প শাস্তিরূপে নির্ণিত হইয়াছে। কুরআন করীমের অন্যত্র বিবাহিতা কৃতদাসীর ব্যভিচারের জন্য শাস্তি প্রসঙ্গে বর্ণিত হইয়াছে যে, সে বিবাহিতা স্বাধীন ব্যভিচারিণী নারীর জন্য নির্ধারিত শাস্তির অর্ধেক ভোগ করিবে (৪ঃ২৬); এবং স্পষ্টতঃই প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডকে অর্ধেক করা যায় না। কুরআন করীম অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যভিচারের শাস্তিরূপে বেত্রাঘাতকে বিধিবদ্ধ করিয়াছে এবং বিবাহিত বা অবিবাহিত অপরাধীর মধ্যে দণ্ডাজ্ঞার বিষয়ে কোন প্রকারে বৈষম্য করে নাই (কারণ আরবী ‘যানী’ অর্থ বিবাহিত এবং অবিবাহিত উভয় অবস্থায় যৌন-অপরাধী)। ইহা খুবই কৌতুহলোদ্দীপক যে, কোন ন্যায্যতা বা ভাষাবিদ্যাগত ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ছাড়াই কোন কোন মুসলিম মহলে এই ভুল ধারণা চালাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, তফসীরাধীন আয়াতটি এই ব্যাপারে কেবল অবিবাহিতের শাস্তি সম্পর্কে ব্যবহৃত এবং বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর শাস্তি প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। মনে হয় হাদীসে লিপিবদ্ধ কয়েকটি ঘটনা হইতে এই ভ্রান্ত ধারণার উদ্ভব হইয়াছিল যখন হযরত রসূল করীম (সাঃ)-এর নির্দেশে বিবাহিত ব্যক্তিরা যৌন অপরাধে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল। এই কয়েকটি ঘটনার একটি ছিল এক ইহুদী পুরুষ এবং এক ইহুদী নারী যাহারা মূসায়ী শরীয়াত অনুযায়ী প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল (বুখারী) তাঁহার নিকট নূতন ঐশী নির্দেশ অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোন মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তওরাতের বিধান মানিয়া চলা মহানবী (সাঃ)-এর নিয়ম ছিল। অপর দুই-একটি বর্ণিত ঘটনায় প্রস্তরাঘাতে দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করা হইয়াছিল, তবে ইহা প্রমাণিত নহে যে, তফসীরাধীন আয়াত নাযেল হওয়ার পূর্বে অথবা পরে অপরাধ সংঘটিত হইয়াছিল। এইরূপ অবস্থায় প্রতিভাত হয় যে, অপরাধ সম্পাদিত হইয়াছিল আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে, কিন্তু বর্ণনাকারীর কিছু ভুল হিসাবের দরুন ধারণা করা হইয়াছিল যে, এই আয়াত নাযেলের পরবর্তীতে ইহা ঘটিয়াছিল। হাদীস-গ্রন্থে ঐতিহাসিক কাল-নির্দেশে ভুল পাওয়া যায় অথবা ব্যভিচার ছাড়া এমন কিছু উত্যক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়া থাকিতে পারে, যে জন্য আঁ-হযরত (সাঃ) দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণকে মৃত্যুদণ্ডের মত চরম শাস্তি দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, যাহা ঘটনা বর্ণনাকারী ধর্তব্যের মধ্যে আনিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। নচেৎ ইহা অভাবনীয় যে, পবিত্র নবী করীম (সাঃ) এই বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ঐশী নির্দেশ লংঘন করিয়া থাকিতে পারেন। ব্যভিচারের দণ্ড সম্বন্ধে ভুল বুঝার আরও একটি সম্ভাব্য কারণ হইতে পারে খলীফা হযরত ওমর এবং আলী (রাঃ)-এর আরোপিত কিছু বর্ণনা। হযরত ওমর (রাঃ) বলিয়াছেন, “আল্লাহ্র কিতাবে ‘রজম’ (পাথর মারা) সম্বন্ধে একটি আয়াত ছিল। নবী করীম (সাঃ) ব্যভিচারীদিগকে পাথর মারিয়া হত্যা করিয়াছিলেন এবং আমরাও তাহার পরে পাথর মারিয়াছিলাম। আমি লিখিয়া রাখিতে পারিতাম, কিন্তু লোকেরা তখন কি বলিত যে, ওমর আল্লাহ্র গ্রন্থে যাহা ছিল না তাহা সংযোজন করিয়াছিল” (কাশফুল ঘোম্মাহ্,২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১১)। সম্পূর্ণ হাদীসটি নির্জলা মিথ্যা উদ্ভাবন বলিয়া প্রতিভাত হয়, অথবা বড় জোর হযরত ওমর (রাঃ)-এর প্রকৃত বর্ণনা ভুল বুঝার ফলশ্রুতি। যাহা কুরআনের অংশ ছিল উহা কুরআনে লিপিবদ্ধ করিলে কেমন করিয়া উহা সংযোজন বলা যাইতে পারিত এবং হযরত ওমর (রাঃ)-এর মত ব্যক্তিত্ব সঠিক কর্ম করিতে কাহার ভয়ে ভীত হইতে পারিতেন। বর্ণিত আছে যে, হযরত আলী (রাঃ) এক ব্যভিচারিণীকে বেত্রাঘাত করার পর প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমি তাহাকে বেত্রাঘাত করিয়াছি ঐশী কিতাবের হুকুম মানিতে এবং পাথর মারিয়া মৃত্যুদণ্ড দিয়াছি পবিত্র রসূল (সাঃ)-এর প্রথানুযায়ী’ (বুখারী)। এই বর্ণনাগুলি হইতে দুইটি বিষয় স্পষ্টতঃ উদ্ভূত হয়ঃ (১) ব্যভিচারের শাস্তির বিষয়ে রসূল করীম (সাঃ)-এর রীতি কুরআন মজীদে বর্ণিত আল্লাহ্র নির্দেশের বিরোধী, কিন্তু তাহা অসম্ভব, (২) কার্যতঃ যখন হযরত ওমর (রাঃ)-এর প্রতি আরোপিত বর্ণনানুযায়ী ঐশী গ্রন্থে ব্যভিচারীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আদেশ ছিল, পক্ষান্তরে হযরত আলী (রাঃ)-এর কথিত মতে এইরূপ কোন হুকুম ছিল না, কিন্তু ইহা কেবল নবী করীম (সাঃ)-এর প্রথা ছিল যেমতে তিনি (আলী-রাঃ) ব্যভিচারের জন্য অপরাধী লোকদিগকে পাথর মারিয়া মৃত্যুদণ্ড দিয়াছিলেন। এই সমস্ত বিরতি কেবল পরস্পর বিরোধীই নহে। বরং এইগুলি প্রকাশ্য ঐশী বিধানের সহিত প্রবল সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। অতএব এগুলি নির্জলা মিথ্যা উদ্ভাবন এবং অবশ্যই বাতিল (আরো দেখুন ‘দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী’ ১৮৩৬-১৮৩৮ পৃষ্ঠা)।