২০০০

যেহেতু ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু তাঁহার জন্মের মতই বিতর্কিত বিষয় হইয়া রহিয়াছে এবং কোথায় এবং কিভাবে তাঁহার জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি অতিবাহিত করিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি এবং সন্দেহ বিদ্যমান। যেহেতু তাঁহার মৃত্যুর বিষয়টি খৃষ্টান ধর্মের বিশ্বাস সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সৃষ্টি করিয়াছে, সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিভ্রান্তিকর এই ধর্মীয় প্রশ্নটি সামগ্রিকভাবে কিছু ব্যাখ্যার দাবী রাখে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রমাণিত সত্যতার নূতন সংযোজনসহ কুরআন মজীদ এবং বাইবেল এই মতের প্রতি অত্যন্ত জোরালো সমর্থন দান করে যে, ঈসা (আঃ) ত্রুশে মৃত্যুবরণ করেন নাই। এই যুক্তি নিম্নবর্ণিত বিশ্লেষণে সমর্থিত এবং সাব্যস্তঃ (১) রুশ পর্যটক নিকোলাস নটোভিচ যিনি ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে দূরপ্রাচ্য পরিভ্রমণে আসিয়াছিলেন, তাঁহার রচিত “ঈসার অজানা জীবন” (দি আননোন লাইফ অব জিসাস) গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, ঈসা (আঃ) কাশ্মীরে এবং আফগানিস্থানে আসিয়াছিলেন। নিকোলাস নটোভিচ যখন কাশ্মীর পরিভ্রমণে আসেন সেই সময়ে কাশ্মীরের মহারাজার কোর্টে কার্যরত বৃটিশ নাগরিক স্যার ফ্রানসিস ইয়ং হাসব্যাণ্ড (Sir Francis younghusband) এর সঙ্গে যজিলা গিরিপথের নিকট তাহার সাক্ষাৎ হয়। ঈসা (আঃ)-এর প্রাচ্য ভ্রমণ সম্পর্কে আধুনিক গবেষণা নটোভিচ-প্রণীত পুস্তকের জোরালো সমর্থন দান করে। অধ্যাপক নিকোলাস রোয়েরিক স্বরচিত “হার্ট অব এশিয়া” (Heart of Asia) পুস্তকে লিখিয়াছেন, ”খৃস্টের সেইস্থানে আগমনের কৌতূহলপূর্ণ লোক কাহিনীর সম্মুখীন হইলাম আমরা সর্বপ্রথম শ্রীনগরে আসিয়া অতঃপর আমরা দেখিতে পাইলাম কিরূপে ব্যাপকভাবে ভারতের লাদাখ এবং মধ্য-এশিয়ার অঞ্চলগুলিতে ঈসা (আঃ)-এর আগমনের গল্প-কাহিনী ছড়াইয়া রহিয়াছে ……. মধ্য-এশিয়ার সর্বত্র, কাশ্মীর, লাদাখ, তিব্বত এবং আরও উত্তরাঞ্চলে এই দৃঢ়বিশ্বাস বিদ্যমান যে, ঈসা (আঃ) এই সকল অঞ্চলে আগমন করিয়াছিলেন” (গ্লিম্পস অব ওয়ার্লড হিষ্টরী, বাই পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু)। কোন কোন পণ্ডিত ব্যক্তি নটোভিচের গ্রন্থের কিছু কিছু অস্পষ্ট ঘটনাবলীর আশ্রয় নিয়াছিলেন এই বলিয়া যে, ঈসা (আঃ) প্রাচ্যে আগমন করিয়াছিলেন নবুওয়াতের দাবীর পূর্বে, পরে নহে। কিন্তু যেমন বলা হইয়াছে ঈসা (আঃ) যখন মাত্র ১৩/১৪ বৎসর বয়সের বালক ছিলেন তখন তিনি হিন্দুস্থানে আসিয়াছিলেন। সেই বয়সে তিনি এত দূরদেশে কষ্টকর ও দীর্ঘ যাত্রার কথা কল্পনাও করিতে পারিতেন না এবং দুর্গম পথে-প্রান্তরে তিনি নিজেকে প্রাণঘাতী বিপদের সম্মুখে ঠেলিয়া দিতে পারিতেন না। মোটকথা, ঈসা (আঃ)-এর এরূপ অল্প বয়সে হিন্দুস্থানে আসার কি এমন আকর্ষণ বা উদ্দেশ্য ছিল? সেই সময় তিনি যদি আদৌ ভারতবর্ষে আসিয়া থাকেন তাহা হইলে সেক্ষেত্রে ভারত ও কাশ্মীরের অধিবাসীগণের এমন কি স্বার্থ ছিল যে কারণে ১৩/১৪ বৎসর বয়সের এক বালকের কর্মকাণ্ড, ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়াইবার কাহিনী প্রচার ও লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল? ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক প্রকৃত ঘটনা এই যে, ইহুদীরা তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিবার পর এবং প্যালেষ্টাইনে তাঁহার জীবন বিপজ্জনক হইয়া উঠিবার পর ঈসা (আঃ) সেই দেশ ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং প্রাচীন বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর “হারাইয়া যাওয়া ইসরাঈল গোত্রকে” খুঁজিয়া বাহির করিবার উদ্দেশ্যে ঈসা (আঃ) ভারত ও কাশমীরে এই দীর্ঘ ও বিপদ-সংকুল সফর করিয়াছিলেন এবং এক শত কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত ঘটনাবহুল জীবন-যাপন করিয়াছিলেন (কঞ্জুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড)। এইভাবে সেই সময়ে তাঁহার কর্মজীবনের ঘটনাসমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছিল। আসিরিয়ান ও ব্যাবিলনবাসী ইহুদীদিগকে সর্বদিকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দিলে এই সকল ইসরাঈলী হারান গোত্রগুলি ইরাক এবং ইরানে বসতি স্থাপন করিয়াছিল এবং পরবর্তীকালে দরিউস্ এবং সাইরাসের রাজত্বকালে ইরানীরা যখন তাহাদের রাজ্য আরও পূর্বদিকে আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তার করিয়াছিল তখন এই গোত্রগুলি স্বদেশ ত্যাগ করিয়া তাহাদের সঙ্গে ঐ সকল দেশে আসিয়াছিল। (২) কাশ্মীরের অধিবাসীরা এবং আফগানরা ‘হারান ইসরাঈলীগণের’ বংশধর। এই দুইটি জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং লিখিত দলীল প্রমাণ ইহার বাস্তব সাক্ষী। তাহাদের শহর এবং উপজাতিগুলির নাম, তাহাদের চালচলন, জীবন যাপনের রীতি-নীতি, আকৃতি-প্রকৃতি এবং আচার-আচরণ, তাহাদের পোষাক-পরিচ্ছদ এবং দৈহিক গঠন ইত্যাদি সমস্তই ইহুদীদিগের সাদৃশ্য বহন করে। তাহাদের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী এবং প্রাচীন শিলালিপি, মুদ্রালপি, তাম্রলিপি প্রভৃতিও এই ধারণার সমর্থন করে। তাহাদের লোক-কাহিনী ইহুদী ঐতিহ্যপূর্ণ। কাশ্মীর নামটিও প্রকৃতপক্ষে ‘কাশির’ যাহার অর্থ ‘সিরীয়ার মত’ (অথবা মনে হয় নূহ (আঃ)-এর পৌত্র ‘কাশ’ বা ‘কুশ’ এর নামে ইহার নামকরণ করা হইয়াছে)। এই সমস্ত বাস্তব ঘটনাবলী এই মতেরই নিশ্চিত সমর্থন প্রদান করে যে, কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের অধিবাসীগণ অধিকাংশই ‘ইসরাঈলী দশটি হারান গোত্র’ এর বংশধর। (৩) এই সমস্ত প্রামাণিক তথ্যের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য এই বাস্তব সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে যে, ঈসা (আঃ) নিশ্চয়ই কাশ্মীরে আগমন করিয়াছিলেন এবং কাশ্মীরের অধিবাসীরা ইসরাঈলী হারান দশটি গোত্রের বংশধর। কিন্তু তাঁহার কাশ্মীরে আগমন, তথায় বসবাস এবং সেখানেই পরলোকগমন করার প্রধান ও অকাট্য প্রমাণ হইল, কাশমীরের শ্রীনগর শহরের খানইয়ার স্ট্রীটে তাঁহার সমাধি-সৌধ, যাহা আজও বিশ্বের বড় বড় পর্যটক, গবেষক, পণ্ডিত এবং খৃষ্টান, মুসলমান ও হিন্দু নির্বিশেষে সকলের দৃষ্টিতেই তীর্থস্থান এবং দর্শনকেন্দ্ররূপে পরিগণিত। রওযাবল নামে খ্যাত এই সৃতি সৌধ ‘ইউস-আসফ’ এর কবর, নবী সাহেবের কবর, সাহেবযাদা নবীর কবর এবং এমনকি ঈসা সাহেবের কবর, এইরূপ বিভিন্ন নামে পরিচিত। সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক তথ্যও প্রমাণানুযায়ী ১৯০০ বৎসরের অধিকর্পূর্বে এই ইউস-আসফ কাশ্মীরে আগমন করিয়াছিলেন এবং উপদেশমূলক গল্প বা রূপকের ভাষায় প্রচার করিয়াছিলেন এবং এইরূপ বহু রূপকের উল্লেখ ইঞ্জিলের অন্তর্ভুক্ত রহিয়াছে। ইতিহাসের কোন কোন গ্রন্থে তিনি নবী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। অধিকন্তু ‘ইউস-আসফ’ বাইবেলে উল্লেখিত একটি নাম যাহার মর্ম ‘ইয়াসু’, অর্থ যে খুঁজিয়া একত্রিত করে। ইহা হযরত ঈসা (আঃ)-এর বর্ণনামূলক নাম, কেননা ইসরাঈলের হারান গোত্রগুলিকে খুঁজিয়া প্রভুর আনুগত্যে একত্রিত করাই ঈসা (আঃ)-এর মিশনের উদ্দেশ্য ছিল, যেমন তিনি বলিয়াছেন, “আমার আরও মেষ আছে সে সকল এ খোঁয়াড়ের নয়, তাহাদিগকেও আমার আনিতে হইবে, এবং তাহারা আমার রব শুনিবে, তাহাতে এক পাল ও এক পালক হইবে।” (যোহন-১০ঃ১৬)। নিম্নলিখিত ঐতিহাসিক উদ্ধৃতিসমূহ এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেঃ “এই সমাধি কোন নবীর বলিয়া পরিচিত। তিনি একজন রাজকুমার ছিলেন যিনি অন্য কোন দেশ হইতে আসিয়াছিলেন এবং কাশ্মীরের অধিবাসীদিগের নিকট প্রচার করিতেন। তাঁহার নাম ছিল ‘ইউস আসফ’ (Yuz Asaf) (তারিখে আজামী পৃষ্ঠা ৮২-৮৫)। ‘ইউস আসফ’ বিভিন্ন ভূখণ্ডে ঘুরিয়া ফিরিয়া কাশ্মীর বলিয়া কথিত দেশটিতে পৌঁছিয়াছিলেন। তিনি এস্থানের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়াছিলেন এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেই দেশেই বাস করিয়াছিলেন (ইকমালুউদ্দীন,পৃষ্ঠা ৩৫৮-৩৫৯)…… আমি শুনিয়াছি যে, কাশ্মীরের লোক-কাহিনীতে এক নবীর উল্লেখ রহিয়াছে যিনি সেখানে বাস করিতেন এবং ছোট ছোট কাহিনীর দ্বারা রূপকের ভাষায় শিক্ষা দিতেন, ঈসা (আঃ) যেরূপ করিতেন। সেইগুলি এখনও কাশ্মীরে পুনরাবৃত্ত হইয়া থাকে (John Noel’s article in Asia oct.১৯৩০)….. অতএব ঈসা (আঃ)-এর ভারতবর্ষে পালাইয়া আসা এবং শ্রীনগরে পরলোক গমন করা বিচার-বুদ্ধিপূর্ণ যুক্তিতে এবং ঐতিহাসিক মতে সত্যের বিরুদ্ধে যায় না (তফসীর আল মানার, ৬ষ্ঠ খণ্ড)। যাহা হউক এই বিষয়ে ভালভাবে আলোচনা করার জন্য প্রতিশ্রুত মসীহ্ হযরত আহমদ কর্তৃক রচিত গ্রন্থ ‘মসীহ হিন্দুস্তান মে’ পাঠ করুন। সুপ্রসিদ্ধ ‘Nazarene Gospel Restored’ গ্রন্থখানাও দেখুন, যাহার প্রণেতা লিখিয়াছেন যে, যদিও সরকারীভাবে ৩০ খৃষ্টাব্দে হযরত ঈসা (আঃ)-কে ক্রুশবিদ্ধ করা হইয়াছিল, তথাপি তাঁহাকে কবর হইতে পুনর্বার উঠাইবার ২০ বৎসর পরেও তিনি জীবিত ছিলেন।’ ক্রুশ অভিশপ্ত মৃত্যু হইতে উদ্ধার পাওয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) এবং তাঁহার মাতা যেস্থানে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করিয়াছিলেন এবং চিরস্থায়ী বিশ্রাম গ্রহণ করিয়াছিলেন সেই স্থান সম্বন্ধে কুরআনের ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে যে, “এক উচ্চ স্থানে আশ্রয় দিয়াছিলাম যাহা বসবাসের যোগ্য এবং ঝর্ণ-বিশিষ্ট ছিল।” ইহা প্রাকৃতিক শোভাময় কাশ্মীর উপত্যকার এক যথাযথ বর্ণনা। নিকোলাস নটোভিচও কাশ্মীরকে চিরস্থায়ী স্বর্গসুখের উপত্যকারাপে আখ্যায়িত করিয়াছেন।