১৮৩৮

ইসরাঈল জাতি সম্পর্কে অভিযোগের সমস্ত ঐতিহাসিক সূত্রের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা অসাধারণ তত্ত্বসমূহ উপস্থাপিত হইয়াছেঃ (ক) তাহারা কখনই মিশরে বসবাস করে নাই, কারণ পুরাতন মিশরীয় ইতিহাসের দলীলে তাহাদের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, (খ) ফেরাউন মেরেনেপতাহ (Merenptah)-এর রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে, যখন হযরত মূসা (আঃ) ইসরাঈলীদিগকে মিশর রাজ্য হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন বলিয়া বলা হয়, সেই সময় কোন কোন ইহুদী উপজাতি বাস্তবেই কেনানে বাস করিত। অতএব এই মত যে, মূসা (আঃ) কেনানে তাহার রাজত্বকালে ইসরাঈলীদিগকে মিশর হইতে বাহির করিয়া সেখানে নিয়া গিয়াছিলেন এবং তাহারা পঞ্চাশ বৎসর পরে কেনানে আবাস স্থাপন করিয়াছিল—এইসব সম্পূর্ণ ভুল। এই অদ্ভূত তত্ত্বের উপস্থাপকগণ মনে হয় ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, ইসরাঈলীরা মিশর দেশে বিদেশী ছিল এবং এক পরাধীন জাতিরূপে তাহারা নির্দয় শাসকের অধীনে কৃতদাসবৎ দায়বদ্ধ কৃষকের ও দাসত্বের দুর্দশাগ্রস্থ জীবনযাপন করিত। এইরূপ এক সম্প্রদায় কিভাবে ঐতিহাসিকগণের দৃষ্টি আকর্ষণের যোগ্য বিবেচিত হইতে পারে? এমনকি এই বিংশ শতাব্দীতেও যখন ইতিহাস রচনাকারীগণ ধংসপ্রাপ্ত সভ্যতার ভগ্নাবশেষ হইতে কোন এক জাতি সম্পর্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা সহজসাধ্য মনে করেন না, তখন বহুদূরবর্তী অতীতের ইতিহাসবিদগণের জন্য আরও অধিক কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল যে, টুকরা টুকরা অসম্পূর্ণ বর্ণনা হইতে এমন এক জাতি সম্পর্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ দলীল রচনা করা, যাহারা অতি প্রাচীনকালে বাস করিত এবং যাহারা তাহাদের শাসক কর্তৃক ভারবাহী পশুর ন্যায় ব্যবহৃত হইত। কোন কোন ইহুদী গোত্রকে ফেরাউন মেরেনেপ্‌ তাহর রাজত্বকালের পঞ্চম বৎসরে কেনানে বাস করিতে দেখা গিয়াছিল, এই সন্দেহপূর্ণ সূত্র সম্বন্ধে উল্লেখ করিতে গেলে বলিতে হয় যে, অন্যান্য ইসরাঈলী গোত্রগুলি মিশরে বাস করিতেছিল—এই বাস্তব ঘটনাকে ইহা মিথ্যা প্রমাণিত করিতে পারে না। ইহা কি সম্ভব নহে যে, মূসা (আঃ) কর্তৃক উহাদের সকলকে উদ্ধার করার প্রাক্কালে কোন কোন গোত্র কেনানের পথে মিশর ত্যাগ করিয়াছিল? ইহা আশ্চর্যের কথা যে, এই সকল লোক একদিকে বলে যে, মূসা মিশরীয় নাম এবং কোন ইহুদীর নামও মিশরীয় নাম ছিল, অপরদিকে বলে যে, তাহারা কখনও মিশরে গমন করে নাই। উপরন্তু ইসরাঈলীগণ মিশরে বাস করিত বলিয়া বাইবেল বিশদ ও সঙ্গত বর্ণনা করিয়াছে। বাইবেল রচয়িতাগণের জন্য এইরূপ করার কোন বাধ্যকর কারণ ছিল না, বিশেষতঃ যখন ইহুদীরা সেখানে কৃতদাস ও ভারবাহী পশুর অপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবনযাপন করিত। কোন জাতিই নিজেদের অপমান ও দুঃখের বেদনাদায়ক মিথ্যা এবং বানোয়াট দলীল আবিষ্কার করিবার গরজ বা গর্ববোধ করিবে না। সেই সময়ের ফেরাউনদের রীতি-নীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের পদ্ধতি সম্বন্ধে বাইবেলের খুঁটিনাটি বর্ণনা আরও একটি বাস্তব প্রমাণ যে, ইহুদী জাতি মিশরে বাস করিত। মিশরীয় ফেরাউন রাজ-বংশে বাইবেলের কোন স্বার্থ ছিল না—এই প্রকৃত বাস্তব ঘটনা ব্যতীত যে, তাহারা ইহুদীদিগের শাসক ছিল। এতদ্ব্যতীত প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিকগণের বর্ণনানুযায়ী, মিশরীয়গণ নিজেরাই স্বীকারোক্তি করিয়াছিল যে,ইসরাঈলী জাতি দীর্ঘদিন মিশরে বসবাস করিয়াছিল এবং পরবর্তী কালে সেখান হইতে হিজরত করিয়াছিল। যাহা হউক পুরাকালে পরিচিত মিশর রাজ্য, যাহা উত্তর আরব নিয়া গঠিত ছিল, উহার সহিত বর্তমানকালের মিশর নিয়া তালগোল পাকানো সমীচীন নহে। মিশরত্যাগী ইসরাঈলীদিগের দলবদ্ধভাবে প্রস্থানের তারিখটিও বহু বিতর্কীত বিষয় এবং কেবলমাত্র বাইবেল হইতে উহার সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা খুবই কষ্টসাধ্য বলিয়া মনে হয়। ঐতিহাসিক সূত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং ইহুদী জাতির ঐতিহ্য দ্বারা সমর্থনপুষ্ট এই ধারণা ব্যাপকভাবে বিদ্যমান যে, উক্ত দলবদ্ধভাবে প্রস্থানের ঘটনা (যাত্রা পুস্তক) পুরুষানুক্রমিক উনবিংশতম রাজ পুরুষ (১৩২৮১২০২ খৃঃ পূর্ব) বা মেরেনেপ্‌তাহ ২য় (Merenptah II) (১২৩৪-১২১৪ খৃঃ পূর্ব)-এর শাসনামলে সংঘটিত হইয়াছিল এবং এখনও ইহা সর্বাধিক সম্ভাব্য বলিয়া প্রতিপন্ন। এই যাত্রা ১২৩০ খৃঃ পূর্বাব্দে হইয়াছিল বলিয়া প্রতীয়মান হয়। অত্যাচারী ফেরাউন ছিল রামেসেস ২য় এবং তাহার উত্তরসূরী মেনেরেপতাহ ২য় ছিল মূসা (আঃ)-এর যাত্রাকালের ফেরাউন। (পীকস্ কমেন্টারী অব দি বাইবেল পৃঃ ১১৯, ৯৫৫, ৯৫৬, আরও দেখুন ‘দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী’ পৃঃ-১৬৪৬-১৬৪৭)।