১৮১২

ইতিহাসের সর্বপ্রকার স্বীকৃত নিয়ম-নীতির বিপরীতে ফ্রয়েড (Freud) তাহার ‘মূসা এবং একেশ্বরবাদ’ (Moses and Monotheism) গ্রন্থে এক সম্পূর্ণ অভিনব মতের অস্পষ্ট আভাষ দিয়াছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) ইসরাঈলী ছিলেন না, তিনি ইহুদী বংশীয় ছিলেন না এবং ইসরাঈলীগণ কখনও মিশরে বসবাস করে নাই। ফ্রয়েড তাহার এই অদ্ভুত দাবীর সমর্থনে নিম্ন বর্ণিত যুক্তির অবতারণা করিয়াছেনঃ (১) মূসা এক মিশরীয় নাম, (২) আল্লাহ্‌তা’লার তৌহীদ (একত্ববাদ)-এর ধারণা মূলতঃ মিশর দেশীয়, প্রাচীন মিশরীয় রাজা ইখনাতেন (বা আখেনাতেন) কর্তৃক প্রথমে ইহা কল্পিত এবং গৃহীত হইয়াছিল; (৩) মূসা নিজে মিশরীয় ছিলেন বিধায় তিনি উহা মিশরবাসীদিগের নিকট হইতে অনুকরণ করিয়াছিলেন এবং ইসরাঈলীগণের মধ্যে প্রচার করিয়াছিলেন। যেহেতু মূসা মিশরীয় ছিলেন, সেই জন্য তিনি হিব্রু ভাষায় নিজেকে স্পষ্টরূপে প্রকাশ করিতে পারিতেন না। এই সকল যুক্তি বাস্তব ঘটনা-ভিত্তিক নহে। মূসা নিশ্চিতরূপে একটি হিব্রু শব্দ, ইহা আরবী এবং হীব্রু উভয় ভাষা হইতে নির্গত। কিন্তু আদৌ যদি মূসা নামটি মিশরীয় হইয়া থাকে তথাপি ইহা প্রতিপন্ন হয় না যে, মূসা মানুষটিও মিশরীয় ছিলেন। যেহেতু ইসরাঈলীগণ মিশরে ফেরাউনের শাসনাধীন জাতি ছিল সেই কারণে মিশরীয় নাম অবলম্বন করা তাহাদের পক্ষে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক ও ন্যায়-সঙ্গত ছিল। অধীনস্থ জাতির লোকেরা তাহাদের শাসকগণের নাম এবং তাহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন এবং প্রথা ইত্যাদি অনুকরণ করিয়া গৌরব অনুভব করিয়া থাকে। একেশ্বরবাদ ধারণার আদি উৎস মিশর, প্রাচীন মিশরীয় রাজা আখেনাতেন কর্তৃক উহা প্রথম কল্পিত ও গৃহীত এবং তাহার দ্বারা ইসরাঈলীগণের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল, এই যুক্তিও সমভাবে ভ্রান্ত। কোন বিশেষ কল্পিত বিষয়বস্তু কোন জাতির একচেটিয়া বলিয়া মনে করা অযৌক্তিক। বিচ্ছিন্ন লোক বা জনগোষ্ঠী একে অন্যের নিকট হইতে গ্রহণ না করিয়া স্বাধীনভাবে অভিন্ন ধারণা বা কল্পনা করিতে পারে। কিন্তু এমনকি যদি ধরিয়া নেওয়া হয় যে, আল্লাহ্‌তা’লার তৌহীদের মতবাদ মূলতঃ মিশরীয় তাহা হইলেও মূসা (আঃ) মিশরের অধিবাসী ছিলেন, এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয় না। একজন আমেরিকান বা এক জার্মান যদি কোন ধারণা বা বিশ্বাস একজন ইংরেজ হইতে নিতে পারে, তাহা হইলে একজন ইহুদী কেন একজন মিশরবাসীর নিকট হইতে কোন ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করিতে পারিবে না? সত্য কথা এই যে, আল্লাহ্‌তা’লার একত্ববাদের ধারণা মিশর বা সিরিয়াবাসীদের দ্বারা কল্পিত নহে, না অন্য কোন জাতির লোকেরা কল্পনা করিয়াছিল। ইহার উৎস আল্লাহ্‌তা’লার বাণী বা ওহী-ইলহাম। হযরত মূসা (আঃ) মিশর দেশীয় ছিলেন, ফ্রয়েডের এই দাবীর অতিরিক্ত ভিত্তি যাত্রা পুস্তক ৪ঃ১০ এর উপর, যাহাতে বলা হইয়াছে যে, তিনি (মূসা) কথা বলায় মন্থর ছিলেন এবং নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করিতে পারিতেন না, এবং ফ্রয়েড সাহেব খামখেয়ালীভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন যে, মূসা (আঃ) হিব্রুভাষায় আস্তে আস্তে কথা বলিতেন। পক্ষান্তরে কুরআন এবং বাইবেল দ্বারা সমর্থিত সম্পর্ণ ঘটনা এই যে, ফেরাউনের নিকট যাইয়া তাঁহার মিশন প্রচারের জন্য যখন আল্লাহ্‌তা’লা কর্তৃক আদিষ্ট হইয়াছিলেন, তখন মূসা (আঃ) আল্লাহ্‌তা’লার নিকট কাতর নিবেদন করিয়াছিলেন এই কারণে যে, জিহ্বার জড়তা হেতু তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করিতে অক্ষম ছিলেন। তর্কের খাতিরে ইহাই যদি যুক্তি হয় যে, মূসা (আঃ) ফেরাউনের ভাষায় অর্থাৎ মিশর দেশের ভাষায় স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করিতে পারিতেন না, তাহা হইলে ইহাতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা (আঃ) মিশরীয় ছিলেন না। প্রকৃত পক্ষে, আরবী এবং হীব্রু ভাষাবিদ্যার দলীল-প্রমাণের সহিত ইহুদীজাতির ঐতিহাসিক এবং বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যের দলীল-প্রমাণ মিলিতভাবে কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত হযরত মূসা (আঃ)-এর সম্পর্কে ঘটনাবলীর সঙ্গে যুক্ত হইয়া সব কিছু এই যুক্তিকে সত্য বলিয়া সমর্থন করে ও প্রমাণ করে যে, হযরত মূসা (আঃ) মিশর দেশীয় ছিলেন না এবং তাঁহার নাম মূলতঃমিশরীয় ছিল না। (দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী ১৬২১-১৬২৩ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।