১৭৫৯

এই আয়াত অনুযায়ী হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম এমন এক সময়ে হইয়াছিল যখন জুদাইয়াতে রক্ষে তাজা পাকা খেজুর ছিল। ইহা দ্বারা স্পষ্টতঃই প্রমাণ হয় যে, ইহা আগষ্ট-সেপ্টেম্বরের মাস ছিল যাহা সেখানকার খেজুরের মৌসুম। কিন্তু খৃষ্টানদিগের প্রচলিত ধারণা মতে ঈসা (আঃ)-এর জন্ম ২৫শে ডিসেম্বর। এই দিনটি খৃষ্টান জগতের সর্বত্র মহাসমারোহে প্রতি বৎসর ‘বড়দিন’ হিসাবে পালিত হইয়া থাকে। খৃষ্টানদের এই বিশ্বাসকে কেবল কুরআন একাই ভুল প্রতিপন্ন করে নাই, বরং ইতিহাস এমনকি বাইবেলের নূতন নিয়মও এই দিনটি সম্বন্ধে এক মত নহে। ঈসা (আঃ)-এর জন্মের সময় সম্বন্ধে লুক লিখিয়াছেন, ‘ঐ অঞ্চলে মেষপালকেরা মাঠে অবস্থান করিতেছিল এবং রাত্রিকালে আপন আপন পাল চৌকি দিতেছিল’ (লুক-২ঃ৭-৮)। লুকের এই বক্তব্যের সমালোচনায় বিশপ বার্ণস তাঁহার রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দি রাইজ অব ক্রিষ্টিয়ানটি’-এর ৭৯ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন; “তদুপরি যীশুর প্রকৃত এবং সঠিক জন্ম তারিখ যে ২৫শে ডিসেম্বর ছিল এই বিশ্বাসের কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত দলীল নাই। বৈথলেহেমের নিকট খোলা মাঠে মেষপালক রাখালদের রাত্রিকালে পাহারারত অবস্থা সম্বন্ধে লুকের বর্ণিত জন্ম-কাহিনী যদি আমরা বিশ্বাস করি, তাহা হইলে যীশুর জন্ম শীতের মওসুমে হয় না, যখন জুদাইয়ার পাহাড়ী এলাকায় রাত্রের তাপমাত্রা এত নীচে নামিয়া যায় যে, তুষারপাতই স্বাভাবিক। অনেক যুক্তি-তর্কের পরে আমাদের বড়দিন অর্থাৎ ক্রিসমাস বা খৃষ্টের জন্মদিন প্রায় ৩০০ খৃষ্টাব্দে হইতে গৃহীত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়।” বিশপ বার্ণসের এই অভিমত এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকা এবং চেম্বার্স এনসাইক্লোপেডিয়া ‘ক্রিসমাস’ অধ্যায় কর্তৃক সমর্থিতঃ “খৃস্টের জন্মের সঠিক দিন তারিখ কখনই সন্তোষজনকভাবে স্থিরীকৃত হয় নাই, কিন্তু গীর্জার পুরোহিতগণ ৩৪০ খৃঃ অঃ যখন এই ঘটনার স্মৃতি-তর্পণ উদযাপনের দিন স্থির করিল, তখন তাহারা অতি বিজ্ঞজনোচিতভাবে মকরক্রান্তিতে সূর্যের অবস্থান দিবসকে নির্ধারণ করিয়াছিল, যে দিনটি তাহাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আনন্দোৎসবের দিন হিসাবে জনসাধারণের মনে পূর্বাহ্নেই গভীরভাবে রেখাপাত করিয়াছিল। মানব প্রণীত পঞ্জিকায় পরিবর্তনের কারণে নিরক্ষ রেখা হইতে সূর্যের দূরতম স্থানে অবস্থানকাল এবং ক্রিসমাস দিবসের মধ্যে অল্প কয়েক দিনের পার্থক্য হয়” (এনসাইক ব্রিট,১৫শ সংস্করণ, ৫ম খণ্ড-৬৪২ এবং ৬৪২-ক পৃষ্ঠা)।…… “দ্বিতীয়স্থানে মকরক্রান্তি সূর্যের জন্মদিবস হিসাবে পরিগণিত হইয়াছিল এবং রোমে ২৫শে ডিসেম্বরে সূর্য-দেবের জন্মতিথি উপলক্ষে পৌত্তলিক উৎসব পালিত হইত। খৃষ্টান যাজক সম্প্রদায় এই জনপ্রিয় প্রচলিত আনন্দ-উৎসবকে বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইয়া ইহাকে আধ্যাত্মিকতার নামে ন্যায়পরায়ণ সূর্যে-দেবের উৎসব হিসাবে পালন করিতে শুরু করিল” (চাচ্চ, এনসাইক)। এনসাইক্লোপেডিয়ার এই বর্ণনাসমূহ পিক (Peake) প্রণীত ‘কমেন্টারী অব দি বাইবেল’ দ্বারা আরও সমর্থিত হইয়াছে। তাহার এই গ্রন্থের ৭২৭ পৃষ্ঠায় পিক বলেনঃ “(যীশুর জন্মের) মৌসুম ডিসেম্বর নহে, আমাদের বড় দিন (Christmas day) তুলনামূলকভাবে পাশ্চাত্যে পরবর্তীতে প্রচলিত সংস্করণ।” সাম্প্রতিককালে খৃষ্টান ধর্ম-মতের উৎপত্তি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক গবেষণা সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণ করিয়াছে যে, ঈসা (আঃ) ডিসেম্বর মাসে জন্ম গ্রহণ করেন নাই। ডঃ জন ডি, ডেভিস (Dr. John D. Davis) তাঁহার রচিত ডিকশনারী অব দি বাইবেল (Dictionary of the Bible) পুস্তকে ‘বৎসর’ (Year) শব্দের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন যে, ইহুদীদের ইলুল (Elul) মাসে খেজুর পাকে এবং ‘পীকের কমেন্টারী অন দি বাইবেল’-এর ১৭৭ পৃষ্ঠায় আমরা দেখিতে পাই যে, ইলুল মাস আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসের অনুরূপ বা সমসাময়িক। ডঃ পীক আরও বলেন, ‘জে স্টুয়ার্ট স্ব-প্রণীত তাহার “হোয়েন ডিড আওয়ার লর্ড অ্যাকচুয়্যালী লিভ” (When did our lord actually live?) পুস্তকে, এংগোরা মন্দিরে রক্ষিত শীলালিপি এবং প্রাচীন চীনের সাহিত্য হইতে উদ্ধৃতি দিয়া খৃষ্টের জীবন কাহিনী সুদূর চীনে ২৫-২৮ খৃঃ অঃ সময়ে প্রাপ্ত বর্ণনার দ্বারা যুক্তির মাধ্যমে যীশুর জন্ম খৃষ্ট-পূর্ব ৮ সনে (সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর) বলিয়া নির্ধারণ করিয়াছেন এবং ২৪ খৃষ্টাব্দের বুধবারে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কথা সাব্যস্ত করিয়াছেন।’ দুইটি এনসাইক্লোপেডিয়ার উপরোক্ত বর্ণনা ‘কমেন্টারী অব দি বাইবেল’-এর উদ্ধৃতি দ্বারা সমর্থিত হইয়া এই ঘটনা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, ঈসা (আঃ) ইহুদীদের ইলুল মাসে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইলুল ইংরাজী মাস আগষ্ট-সেপ্টেম্বরের অনুরূপ বা ঐক্যযুক্ত, যে সময় জুদাইয়াতে খেজুর পাকার মওসুম এবং ২৫শে ডিসেম্বরে নহে যেভাবে খৃষ্টান গীর্জাগুলি আমাদিগকে বিশ্বাস করাইতে চাহে। পবিত্র কুরআনও এই মতই ব্যক্ত করে। প্রকৃত ঘটনাটি হইল, ঈসা (আঃ)-এর জন্ম তারিখ নির্ধারণের সমস্ত গোলমাল সৃষ্টির কারণ মনে হয় হযরত মরিয়মের গর্ভধারণের তারিখ সম্পর্কে বিভ্রান্তি। নভেম্বর অথবা ডিসেম্বর মাসে মরিয়ম গর্ভধারণ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রতিভাত হয়, চার্চ্চের ইতিহাসবিদগণের বিশ্বাস মতে মার্চ বা এপ্রিল মাসে নহে। চার-পাঁচ মাস গর্ভধারণের পর গর্ভাবস্থাকে দৃষ্টিগোচর হইতে আড়ালে রাখা যখন আর সম্ভব ছিল না তখন মরিয়মকে নিয়া পরবর্তী বৎসর মার্চ অথবাএপ্রিল মাসে যোসেফের বাড়ীতে চলিয়া যাওয়ার জন্য যোসেফকে বুঝাইয়া রাজি করান হইল। এইভাবেই খৃষ্টান ঐতিহাসিকগণ মার্চ বা এপ্রিল মাসকে— যখন মরিয়মকে যোসেফের বাড়ীতে নেওয়া হইয়াছিল— তাঁহার গর্ভধারণের মাস বলিয়া ভুল করিয়াছিল যাহা চার-পাঁচ মাস পূর্বেই ঘটিয়াছিল। তফসীরাধীন আয়াত হইতে ইহা দেখা যায় যে, মরিয়ম পর্বত গোত্রের উপরিভাগে কোন ছাউনি বা আবরণের মধ্যে আশ্রয় নিয়াছিল এবং পাহাড়ের ঢালুতে খেজুর বৃক্ষ দণ্ডায়মান ছিল এবং এই জন্যই মরিয়ম সহজেই সেই বৃক্ষের নিকট পৌঁছিয়া উহাতে নাড়া দিতে পারিয়াছিলেন। বৈথলেহেম অঞ্চল যে খেজুর বৃক্ষ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল উহা বাইবেল হইতে সুস্পষ্ট (বিচারক-১ঃ১৬) এবং ডঃ জন ডি, ডেভিস, ডি, ডি প্রণীত ‘এ ডিকশনারী অব দি বাইবেল’ হইতেও স্পষ্ট। এতদ্ব্যতীত পূর্ববর্তী আয়াতে যেমন উল্লেখ করা হইয়াছে যে, মরিয়ম নিকটবর্তী ঝর্ণাটিতে গিয়া পানি পান করিতে এবং নিজেকে ধৌত করিতে নির্দেশিত হওয়ার ঘটনাই অঙ্গুলী নির্দেশ করিতেছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে ভূমিষ্ট হইয়াছিলেন, কারণ জুদাইয়ার বরফ গলানো আবহাওয়াতে মরিয়মের পক্ষে খোলা বাতাসে গোসল করা বা নিজেকে ধৌত করা সম্ভব ছিল না (দি লারজার এডিশন অব দি কমেন্টারী, ১৫৭৩-১৫৭৬ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।