‘যুলকারনায়ন’-এর পরিচয় জানার পূর্বে, ইহা বলা প্রয়োজন যে, তাহার ঘটনা কেন কুরআনে বর্ণিত হইয়াছে এবং কেন ইহা এত গুরুত্বপূর্ণভাবে এই সূরাতে স্থান পাইয়াছে। ইতিপূর্বে এই সূরাতে পাশ্চাত্যের খৃষ্টান জাতিসমূহের কৃতিত্বপূর্ণ পার্থিব উন্নতির বিষয়ে দুইটি যুগের সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহার প্রারম্ভিক আয়াতগুলিতে গুহার অধিবাসীগণ সম্বন্ধে কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। গুহাবাসীদিগের উপর যুলুম-অত্যাচারের বর্ণনা এবং পরবর্তীকালে তাহাদের উত্তর সূরীগণের অর্থাৎ পশ্চিমা খৃষ্টান জাতিসমূহের জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতির বর্ণনা দেওয়ার পূর্বে, হযরত মূসা (আঃ)-এর ‘ইসরা’ বা আধ্যাত্মিক ভ্রমণ বৃত্তান্তে কিছু বিস্তারিত বর্ণনা রহিয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ)-এর আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথে খৃষ্টান জাতির পার্থিব উন্নতির ও অগ্রগতির প্রথম যুগ শেষ হইয়া যাইবে। যদিও তাহাদের পক্ষে আরো উন্নতি করার সম্ভাবনা থাকিবে এবং আঁ-হযরত (সাঃ)-এর আর্বিভাবের অনেক পরে তাহারা সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছবে। খৃষ্টান জাতির এই দ্বিতীয় জাঁকজমকপূর্ণ অধ্যায়কে ঐশী গ্রন্থে ইয়া’জুজ-মা’জুজ (গগ এণ্ড ম্যাগগ)-এর বিস্ময়কর শক্তি বৃদ্ধির প্রতীক রূপে চিহ্নিত করা হইয়াছে, যাহা বর্তমান সূরার কেন্দ্রীয় বিষয় বস্তুসমূহের মধ্যে একটি। কারণ রাজনৈতিক ভাবে ইয়া’জুজ-মা’জুজ এবং যুলকারনায়ন একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, যাহা পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে যুলকারনায়নের বিষয়ে দেওয়া বিবরণ হইতে প্রতিভাত হইবে। মনে হয় যুলকারনায়ন মাদীয় এবং পারস্য সাম্রাজ্যের (মেডোপারশিয়ান এমপায়ার) প্রতিষ্ঠাতা রাজা ছিলেন, যাহা দানিয়েল নবীর বিখ্যাত স্বপ্নে পরিদৃষ্ট ভেড়ার দুই শিং-এর প্রতীক। “আমি দেখিলাম ঐ মেষ পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে ঢুস মারিল, তাহার সম্মুখে কোন জন্তু দাঁড়াইতে পারিল না, এবং তাহার হস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারে এমন কেহ ছিল না, আর সে স্বেচ্ছামত কর্ম করিত, আর আত্মগরিমা করিত।” “তুমি দুই শৃঙ্গ বিশিষ্ট যে মেষ দেখিলে, সে মাদীয় ও পারশীক রাজা” (দানিয়েল-৮ঃ৪,২০,২১)। দানিয়েল নবীর স্বপ্নের উক্ত অংশের সাথে পুরাদস্তুর সঙ্গতি রাখিয়া কুরআন করীম যুলকারনায়নের ত্রিমুখী অভিযানের কথা উল্লেখ করিয়াছে (আয়াত—৮৭,৯১৯৪)। এই ঘটনার দ্বারা যুলকারনায়ন যে মাদিয়া এবং পারস্য রাজ্যের বর্ণনামূলক নাম ছিল উহার জোর সমর্থন পাওয়া যায়। এবং কুরআনের বর্ণনা, সকল মেদো-পারস্য রাজাদের মধ্যে সাইরাসের প্রতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সামঞ্জস্যপূর্ণ। যুলকারনায়নের চারটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন কুরআনে উল্লেখিত হইয়াছেঃ (ক) তিনি বংশানুক্রমিক এক ক্ষমতাশালী শাসক ছিলেন (আয়াত-৮৫.৮৯), (খ) তিনি একজন ধার্মিক বান্দা ছিলেন এবং ঐশী-বাণী দ্বারা অনুগৃহীত হইয়াছিলেন (আয়াত-৯২৯৯) (গ) তিনি পশ্চিম দিকে অভিযান চালাইয়াছিলেন এবং বিরাট বিজয়ের পর পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত গমনস্থলে যাওয়ার সময় পর্যন্ত এমন এক স্থানে পৌছিলেন যাহা দেখিতে ঝাপসা সরোবর বা নদী-নালার গভীর অংশ এবং তখন তিনি পূর্বদিকে যাত্রা করিলেন এবং এক বিরাট রাজ্য জয় করিয়া বশীভূত করিলেন (আয়াত-৮৭,৮৮), (ঘ) তিনি মধ্যাঞ্চলে উপস্থিত হইলেন যেখানে অসভ্য বর্বর জাতি বাস করিত এবং সেখানে ইয়া’জুজ-মা’জুজ ব্যাপকভাবে অনধিকার প্রবেশ করিয়াছিল, তিনি সেই প্রবেশ পথগুলি দেওয়াল দ্বারা বন্ধ করিয়া দিলেন (আয়াত-৯৪-৯৮)। প্রাচীন যুগের বিখ্যাত শাসনকর্তা এবং প্রসিদ্ধ সামরিক সেনাপতিদিগের মধ্যে সাইরাস, উপরোল্লিখিত চারটি গুণাবলীর বিপুল পরিমাণে অধিকারী ছিলেন। সুতরাং কুরআন শরীফে উল্লেখিত যুলকারনায়ন হিসাবে বিবেচিত হওয়ার উপযুক্ত হইতেছেন ইতিহাসের ‘সাইরাস দি গ্রেট’ (যিশাইয়-৪৫, ইস্লা- ১ও২, ২-বংশাবলী-৩৬ঃ ২২-২৩, হিষ্টরিয়ানস্ হিষ্টরি অফ দি ওয়ার্লড, ‘সাইরাস’ অধ্যায়)।